শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ৫ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ফেইসবুক নিয়ে একের পর এক বোমা ফাটালেন হাউজেন

ফেইসবুকের ১০ হাজার পাতার অভ্যন্তরীণ গবেষণা ও নথি ফাঁসকারী হুইসেলব্লোয়ার ফ্রান্সিস হাউজেন ফেইসবুকের অভ্যন্তরীণ কার্যপ্রণালী নিয়ে একের পর এক বোমা ফাটিয়ে চলেছেন, যা ফেইসবুকের জন্য শুধু বড় ধাক্কা নয়, সম্ভবত পাল্টে দেবে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি সাধারণ ব্যবহারকারীদের দৃষ্টিভঙ্গিও।

আজ মঙ্গলবার মার্কিন সিনেটে সাক্ষ্য দেওয়ার কথা ছিল তার। ঠিক তার আগের দিন মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে ফেইসবুকের নানা নেতিবাচক দিক নিয়ে কথা বলেন তিনি।

ফেইসবুক শুধু নিজের স্বার্থই দেখে উল্লেখ করে হাউজেন বলেন, ‘ফেইসবুকে আমি যেটা বারবার দেখেছি সেটা হলো, জনসাধারণের জন্য কোনটা ভালো আর ফেইসবুকের জন্য কোনটা ভালো, তার মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। আর ফেইসবুক প্রতিবারই আরও বেশি মুনাফা অর্জনের মতো নিজের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছ’।

তার চোখে ফেইসবুকের অবস্থাই সবচেয়ে বাজে। সামাজিক মাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বাজে অবস্থা ফেইসবুকের, উল্লেখ করে তিনি বলেন ‘আমি বেশ কয়েকটি সামাজিক মাধ্যম দেখেছি। কিন্তু আমি আগে যা দেখেছি, সেই তুলনায় ফেইসবুকের সবকিছুই যথেষ্ট খারাপ’।

অনলাইনে ভুয়া তথ্যের প্রচারণা, মিথ্যাচার, সহিংসতা বন্ধে বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের দাবি করে আসছে ফেইসবুক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব গবেষণা বলছে একদমই উল্টো কথা। সমাজব্যবস্থার উপর প্ল্যাটফর্মটির বিরূপ প্রভাবের প্রমাণ উঠে এসেছে একাধিক সূত্র থেকে।

এ প্রসঙ্গে ফেইসবুক সমাজব্যবস্থা ‘ছিড়ে ফেলছে’ মন্তব্য করে হাউজেন বলেন, ‘আমরা এমন একটি তথ্যনির্ভর পারিপার্শিক অবস্থার মধ্যে আছি যেটা ক্ষোভ, বিদ্বেষ এবং মেরুকরণের কন্টেন্ট দিয়ে পূর্ণ, এটা আপনার নাগরিক বিশ্বাসকে ক্ষয় করতে থাকে, একে অন্যের উপর বিশ্বাস নষ্ট করতে থাকে, আমাদের একে অন্যের যত্ন নেওয়ার ক্ষমতা কমাতে থাকে। ফেইসবুকের যে সংস্করণটি এখন আছে সেটা আমাদের সমাজব্যবস্থাকে ছিড়ে ফেলছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিগত সহিংসতার জন্ম দিচ্ছে’।

সামাজিক দায়বদ্ধতারও ধার ধারে না ফেইসবুক। লোক দেখানো কর্মকাণ্ড দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচক আর নীতিনির্ধারকদের খুশি রাখতে পারলে তাতেই খুশি ফেইসবুক, এর বাইরে সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা নেই প্রতিষ্ঠানটির; এমনটাই বলছেন হাউজেন।

‘ফেইসবুকের যে বিভাগে আমি কাজ করতাম, তার নাম ছিলো ‘নাগরিক শুদ্ধতা (সিভিক ইন্টিগ্রিটি)’। ফেইসবুক যেন সমাজের জন্য একটি ইতিবাচক শক্তি হয়ে উঠে, সেটা নিশ্চিত করাই ছিলো ওই বিভাগটির দায়িত্ব। এবং নির্বাচনের ঠিক পর পরই তারা আমাদের বলে যে, আমরা বিভাগটি ভেঙে দিচ্ছি। তাদের ভাবখানা এমন ছিল যেন– ওহ কী সুন্দর, আমরা নির্বাচন পাড় হয়ে গেছি, কোথাও দাঙ্গা হয়নি, আমরা সিভিক ইন্টিগ্রিটি বন্ধ করে দিতেই পারি’।

‘তারা যখন সিভিক ইন্টিগ্রিটি বন্ধ করে দেয়, তখনই আমার মনে হয় যে ফেইসবুক বিপজ্জনক হয়ে উঠা ঠেকাতে যেখানে যে বিনিয়োগ প্রয়োজন সেখানে সেই বিনিয়োগ করার ইচ্ছা তাদের নেই’।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন চলাকালীন ভুয়া তথ্যের প্রচার ঠেকাতে ফেইসবুক নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাময়িকভাবে চালু রেখেছিলো বলে জানান হাউজেন। ‘নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, তারা সেটি বন্ধ করে দিয়েছিলো অথবা সেটিংস পাল্টে আগের অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলো, যা সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা মনে হয়েছে’, বলেন তিনি।

ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা প্রশ্নে বাড়তি কর্মী নিতে চায়নি উল্লেখ করে হাউজেন জানান, ব্যবহারকারীদের সাইবার নিরাপত্তাকেও গুরুত্ব দেয়না ফেইসবুক। হাজার কোটি ডলারের প্রতিষ্ঠান হলেও সাইবার নিরাপত্তা দিতে প্রয়োজনীয় কর্মী নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টিকে একেবারেই গুরুত্বে সঙ্গে নেন না ফেইসবুকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।

হাউজেন বলেন, ‘আমার কাউন্টার এসপিওনাজ টিমে দশ জনেরও কম কর্মী ছিলো। চীন যখন তাইওয়ানের নাগরিকদের উপর নজরদারি চালায় বা উইঘুরদের উপর নজরদারি চালায়, ছয়-সাতজন মানুষ মিলে সেটা কীভাবে মোকাবেলা করবে? আমাদের হাতে যতো কেইস থাকতো তার এক তৃতীয়াংশ নিয়ে কাজ করতে পারতাম আমরা। আমাদের বসে তালিকা বানাতে হতো যে কাকে আমরা রক্ষা করতে পারবো আর কাকে পারবো না। কিন্তু এমনটা হওয়ার কেনো কারণ নেই। আমরা চাইলেই দশগুণ কর্মী নিতে পারতাম। আমাদের কাছে যে কেইসগুলো ছিলো, সেগুলো মোকাবেলা করতে পারছিলাম না বলে আমরা ইচ্ছা করেই কোনো ডিটেকশন সিস্টেম বানাইনি’।

আর পুরো বিষয়টি নিয়ে অবহিত ছিলেন ফেইসবুকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। ‘আমি যখনই আমার দুশ্চিন্তাগুলো প্রকাশ করেছি, বলেছি যে আমাদের যথেষ্ট কর্মী নেই, আমাকে সরাসরি বলা হয়েছে যে, ফেইসবুকে আমরা অনেক কিছুর কমতি নিয়েই অসম্ভবকে সম্ভব করি, যা সম্ভব হবে বলে আগে কেউ চিন্তাই করেনি’, যোগ করেন হাউজেন।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের উপর ফেইসবুকের প্রভাব ‘ভয়াবহ’ এবং ফেইসবুকের এই প্রভাব তাকে ‘আতঙ্কিত’ করে বলে জানিয়েছেন হাউজেন। বিশ্বের বিভিন্ন দুর্গম প্রান্তে ইন্টারনেট সেবা চালু করে গ্রাহক টেনেছে ফেইসবুক। সেই সংযোগের সূত্র ধরে, পরবর্তী কোন দেশটি সংকটের মুখে পড়বে সেটি আঁচ করতে বছর দুয়েক আগে ফেইসবুক কোন দেশগুলোতে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিয়েছে, সেগুলোর দিকে নজর দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।

‘তথ্য প্রযুক্তি নিরপেক্ষ নয়। এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণের টাকা কামায় ফেইসবুক। যখনই ফেইসবুক কোনো নতুন ভাষার অঞ্চলে প্রবেশ করে, ইংরেজি বা ফরাসী ভাষার বাজারের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়, ওই একই পরিমাণ বা আরও বেশি অর্থ খরচ হয় ওই ভাষার জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করতে। প্রতিটি নতুন ভাষার জন্য অর্থ খরচ হয়, কিন্তু গ্রাহকের সংখ্যা কমতে থাকে। তাই অর্থনীতির বিচারে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিনিয়োগ ফেইসবুকের কাছে যৌক্তিক মনে হয় না’।

প্রতিটি ভাষার জন্য আলাদা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও তথ্য যাচাইয়ের জন্য স্বাধীন তৃতীয় পক্ষ না থাকায় ফেইসবুক ভুয়া তথ্যের প্রচারণায় অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এর ফলে মানুষ মারাও যাচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি শঙ্কিত যে এটা এমন একটা শক্তি যা পুরো সমাজব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলবে’।

ফেসবুক ব্যবহারকারীরা তাদের টাইমলাইনে কোন কন্টেন্ট দেখবেন সেটি নির্ধারণের জন্য ফেইসবুকের যে অ্যালগরিদম রয়েছে তা প্রতিষ্ঠানটির প্রচার করা লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে ফেসবুকের নিজস্ব গবেষণাতেই উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন হাউজেন। ফেইসবুকে সবচেয়ে বেশি ট্রাফিক টানছে বিদ্বেষপূর্ণ কন্টেন্ট। এমন কন্টেন্ট প্রকাশ না করলে প্রয়োজনীয় ইউজার ট্রাফিক পায় না ফেইসবুক, যার উপর প্রতিষ্ঠানটির আয় নির্ভর করে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোও এই বিষয়টি জানে এবং এর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে বলে উঠে এসেছে ফেইসবুকের নিজস্ব গবেষণাতেই।

হাউজেন বলেন ‘এখন আমরা যদি রাগী, বিদ্বেষপূর্ণ, মেরুকরণপ্রবণ কন্টেন্ট প্রকাশ না করি, আমরা তাহলে কোনো কিছুই পাই না। আমরা আগে এটা খুব কম করতাম, কিন্তু এখন আমরা যদি এটা না করি তাহলে আমরা ট্রাফিক আর এনগেজমেন্ট পাই না। আর সেটা না পেলে আমাদের চাকরিও থাকবে না’।

‘আপনার হাতে যখন এমন একটি ব্যবস্থা থাকবে যেটা রাগ দিয়েই হ্যাক করা যায়, আর প্রকাশকরা যখন ভাববে যে, ওহ আমি যদি আরও বেশি আক্রমণাত্মক, বিদ্বেষপূর্ণ কন্টেন্ট প্রকাশ করি তাহলে বেশি টাকা কামাবো আমি; তখন পুরো বিষয়টি ফেইসবুকের জন্যেও লাভজনক এবং প্রকাশকদের জন্যেও লাভজনক, ফেইসবুক এমন একটা প্রণোদনা ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছে যা মানুষকে একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে’ বলেন হাউজেন।

বিদ্বেষপূর্ণ আক্রমণাত্মক কন্টেন্টে এনগেজমেন্ট বেশি হয় বলে তেমন কন্টেন্টগুলোই ব্যবহারকারীদের টাইমলাইনে বেশি দেখায় ফেইসবুকরে অ্যালগরিদম। এই বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোও জানে এবং ফেইসবুক অ্যালগরিদমের কারণে জটিল পরিস্থিতিতে পড়ছে তারাও। ভোট লড়াইয়ে শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে আক্রমণাত্মক কন্টেন্টের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোকেও।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সর্বাধিক পঠিত

ফেইসবুক নিয়ে একের পর এক বোমা ফাটালেন হাউজেন

প্রকাশিত সময় : ১০:৩৩:১৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ অক্টোবর ২০২১

ফেইসবুকের ১০ হাজার পাতার অভ্যন্তরীণ গবেষণা ও নথি ফাঁসকারী হুইসেলব্লোয়ার ফ্রান্সিস হাউজেন ফেইসবুকের অভ্যন্তরীণ কার্যপ্রণালী নিয়ে একের পর এক বোমা ফাটিয়ে চলেছেন, যা ফেইসবুকের জন্য শুধু বড় ধাক্কা নয়, সম্ভবত পাল্টে দেবে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি সাধারণ ব্যবহারকারীদের দৃষ্টিভঙ্গিও।

আজ মঙ্গলবার মার্কিন সিনেটে সাক্ষ্য দেওয়ার কথা ছিল তার। ঠিক তার আগের দিন মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে ফেইসবুকের নানা নেতিবাচক দিক নিয়ে কথা বলেন তিনি।

ফেইসবুক শুধু নিজের স্বার্থই দেখে উল্লেখ করে হাউজেন বলেন, ‘ফেইসবুকে আমি যেটা বারবার দেখেছি সেটা হলো, জনসাধারণের জন্য কোনটা ভালো আর ফেইসবুকের জন্য কোনটা ভালো, তার মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। আর ফেইসবুক প্রতিবারই আরও বেশি মুনাফা অর্জনের মতো নিজের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছ’।

তার চোখে ফেইসবুকের অবস্থাই সবচেয়ে বাজে। সামাজিক মাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বাজে অবস্থা ফেইসবুকের, উল্লেখ করে তিনি বলেন ‘আমি বেশ কয়েকটি সামাজিক মাধ্যম দেখেছি। কিন্তু আমি আগে যা দেখেছি, সেই তুলনায় ফেইসবুকের সবকিছুই যথেষ্ট খারাপ’।

অনলাইনে ভুয়া তথ্যের প্রচারণা, মিথ্যাচার, সহিংসতা বন্ধে বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের দাবি করে আসছে ফেইসবুক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব গবেষণা বলছে একদমই উল্টো কথা। সমাজব্যবস্থার উপর প্ল্যাটফর্মটির বিরূপ প্রভাবের প্রমাণ উঠে এসেছে একাধিক সূত্র থেকে।

এ প্রসঙ্গে ফেইসবুক সমাজব্যবস্থা ‘ছিড়ে ফেলছে’ মন্তব্য করে হাউজেন বলেন, ‘আমরা এমন একটি তথ্যনির্ভর পারিপার্শিক অবস্থার মধ্যে আছি যেটা ক্ষোভ, বিদ্বেষ এবং মেরুকরণের কন্টেন্ট দিয়ে পূর্ণ, এটা আপনার নাগরিক বিশ্বাসকে ক্ষয় করতে থাকে, একে অন্যের উপর বিশ্বাস নষ্ট করতে থাকে, আমাদের একে অন্যের যত্ন নেওয়ার ক্ষমতা কমাতে থাকে। ফেইসবুকের যে সংস্করণটি এখন আছে সেটা আমাদের সমাজব্যবস্থাকে ছিড়ে ফেলছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিগত সহিংসতার জন্ম দিচ্ছে’।

সামাজিক দায়বদ্ধতারও ধার ধারে না ফেইসবুক। লোক দেখানো কর্মকাণ্ড দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচক আর নীতিনির্ধারকদের খুশি রাখতে পারলে তাতেই খুশি ফেইসবুক, এর বাইরে সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা নেই প্রতিষ্ঠানটির; এমনটাই বলছেন হাউজেন।

‘ফেইসবুকের যে বিভাগে আমি কাজ করতাম, তার নাম ছিলো ‘নাগরিক শুদ্ধতা (সিভিক ইন্টিগ্রিটি)’। ফেইসবুক যেন সমাজের জন্য একটি ইতিবাচক শক্তি হয়ে উঠে, সেটা নিশ্চিত করাই ছিলো ওই বিভাগটির দায়িত্ব। এবং নির্বাচনের ঠিক পর পরই তারা আমাদের বলে যে, আমরা বিভাগটি ভেঙে দিচ্ছি। তাদের ভাবখানা এমন ছিল যেন– ওহ কী সুন্দর, আমরা নির্বাচন পাড় হয়ে গেছি, কোথাও দাঙ্গা হয়নি, আমরা সিভিক ইন্টিগ্রিটি বন্ধ করে দিতেই পারি’।

‘তারা যখন সিভিক ইন্টিগ্রিটি বন্ধ করে দেয়, তখনই আমার মনে হয় যে ফেইসবুক বিপজ্জনক হয়ে উঠা ঠেকাতে যেখানে যে বিনিয়োগ প্রয়োজন সেখানে সেই বিনিয়োগ করার ইচ্ছা তাদের নেই’।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন চলাকালীন ভুয়া তথ্যের প্রচার ঠেকাতে ফেইসবুক নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাময়িকভাবে চালু রেখেছিলো বলে জানান হাউজেন। ‘নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, তারা সেটি বন্ধ করে দিয়েছিলো অথবা সেটিংস পাল্টে আগের অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলো, যা সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা মনে হয়েছে’, বলেন তিনি।

ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তা প্রশ্নে বাড়তি কর্মী নিতে চায়নি উল্লেখ করে হাউজেন জানান, ব্যবহারকারীদের সাইবার নিরাপত্তাকেও গুরুত্ব দেয়না ফেইসবুক। হাজার কোটি ডলারের প্রতিষ্ঠান হলেও সাইবার নিরাপত্তা দিতে প্রয়োজনীয় কর্মী নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টিকে একেবারেই গুরুত্বে সঙ্গে নেন না ফেইসবুকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।

হাউজেন বলেন, ‘আমার কাউন্টার এসপিওনাজ টিমে দশ জনেরও কম কর্মী ছিলো। চীন যখন তাইওয়ানের নাগরিকদের উপর নজরদারি চালায় বা উইঘুরদের উপর নজরদারি চালায়, ছয়-সাতজন মানুষ মিলে সেটা কীভাবে মোকাবেলা করবে? আমাদের হাতে যতো কেইস থাকতো তার এক তৃতীয়াংশ নিয়ে কাজ করতে পারতাম আমরা। আমাদের বসে তালিকা বানাতে হতো যে কাকে আমরা রক্ষা করতে পারবো আর কাকে পারবো না। কিন্তু এমনটা হওয়ার কেনো কারণ নেই। আমরা চাইলেই দশগুণ কর্মী নিতে পারতাম। আমাদের কাছে যে কেইসগুলো ছিলো, সেগুলো মোকাবেলা করতে পারছিলাম না বলে আমরা ইচ্ছা করেই কোনো ডিটেকশন সিস্টেম বানাইনি’।

আর পুরো বিষয়টি নিয়ে অবহিত ছিলেন ফেইসবুকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। ‘আমি যখনই আমার দুশ্চিন্তাগুলো প্রকাশ করেছি, বলেছি যে আমাদের যথেষ্ট কর্মী নেই, আমাকে সরাসরি বলা হয়েছে যে, ফেইসবুকে আমরা অনেক কিছুর কমতি নিয়েই অসম্ভবকে সম্ভব করি, যা সম্ভব হবে বলে আগে কেউ চিন্তাই করেনি’, যোগ করেন হাউজেন।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের উপর ফেইসবুকের প্রভাব ‘ভয়াবহ’ এবং ফেইসবুকের এই প্রভাব তাকে ‘আতঙ্কিত’ করে বলে জানিয়েছেন হাউজেন। বিশ্বের বিভিন্ন দুর্গম প্রান্তে ইন্টারনেট সেবা চালু করে গ্রাহক টেনেছে ফেইসবুক। সেই সংযোগের সূত্র ধরে, পরবর্তী কোন দেশটি সংকটের মুখে পড়বে সেটি আঁচ করতে বছর দুয়েক আগে ফেইসবুক কোন দেশগুলোতে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিয়েছে, সেগুলোর দিকে নজর দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।

‘তথ্য প্রযুক্তি নিরপেক্ষ নয়। এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণের টাকা কামায় ফেইসবুক। যখনই ফেইসবুক কোনো নতুন ভাষার অঞ্চলে প্রবেশ করে, ইংরেজি বা ফরাসী ভাষার বাজারের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়, ওই একই পরিমাণ বা আরও বেশি অর্থ খরচ হয় ওই ভাষার জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করতে। প্রতিটি নতুন ভাষার জন্য অর্থ খরচ হয়, কিন্তু গ্রাহকের সংখ্যা কমতে থাকে। তাই অর্থনীতির বিচারে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিনিয়োগ ফেইসবুকের কাছে যৌক্তিক মনে হয় না’।

প্রতিটি ভাষার জন্য আলাদা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও তথ্য যাচাইয়ের জন্য স্বাধীন তৃতীয় পক্ষ না থাকায় ফেইসবুক ভুয়া তথ্যের প্রচারণায় অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে এবং এর ফলে মানুষ মারাও যাচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি শঙ্কিত যে এটা এমন একটা শক্তি যা পুরো সমাজব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলবে’।

ফেসবুক ব্যবহারকারীরা তাদের টাইমলাইনে কোন কন্টেন্ট দেখবেন সেটি নির্ধারণের জন্য ফেইসবুকের যে অ্যালগরিদম রয়েছে তা প্রতিষ্ঠানটির প্রচার করা লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে ফেসবুকের নিজস্ব গবেষণাতেই উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন হাউজেন। ফেইসবুকে সবচেয়ে বেশি ট্রাফিক টানছে বিদ্বেষপূর্ণ কন্টেন্ট। এমন কন্টেন্ট প্রকাশ না করলে প্রয়োজনীয় ইউজার ট্রাফিক পায় না ফেইসবুক, যার উপর প্রতিষ্ঠানটির আয় নির্ভর করে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোও এই বিষয়টি জানে এবং এর সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে বলে উঠে এসেছে ফেইসবুকের নিজস্ব গবেষণাতেই।

হাউজেন বলেন ‘এখন আমরা যদি রাগী, বিদ্বেষপূর্ণ, মেরুকরণপ্রবণ কন্টেন্ট প্রকাশ না করি, আমরা তাহলে কোনো কিছুই পাই না। আমরা আগে এটা খুব কম করতাম, কিন্তু এখন আমরা যদি এটা না করি তাহলে আমরা ট্রাফিক আর এনগেজমেন্ট পাই না। আর সেটা না পেলে আমাদের চাকরিও থাকবে না’।

‘আপনার হাতে যখন এমন একটি ব্যবস্থা থাকবে যেটা রাগ দিয়েই হ্যাক করা যায়, আর প্রকাশকরা যখন ভাববে যে, ওহ আমি যদি আরও বেশি আক্রমণাত্মক, বিদ্বেষপূর্ণ কন্টেন্ট প্রকাশ করি তাহলে বেশি টাকা কামাবো আমি; তখন পুরো বিষয়টি ফেইসবুকের জন্যেও লাভজনক এবং প্রকাশকদের জন্যেও লাভজনক, ফেইসবুক এমন একটা প্রণোদনা ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছে যা মানুষকে একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে’ বলেন হাউজেন।

বিদ্বেষপূর্ণ আক্রমণাত্মক কন্টেন্টে এনগেজমেন্ট বেশি হয় বলে তেমন কন্টেন্টগুলোই ব্যবহারকারীদের টাইমলাইনে বেশি দেখায় ফেইসবুকরে অ্যালগরিদম। এই বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোও জানে এবং ফেইসবুক অ্যালগরিদমের কারণে জটিল পরিস্থিতিতে পড়ছে তারাও। ভোট লড়াইয়ে শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে আক্রমণাত্মক কন্টেন্টের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোকেও।