মেহমানদারি করা নবীদের অন্যতম একটি আদর্শ। মেহমানদারির মাধ্যমে মানুষে-মানুষে বন্ধন দৃঢ় হয়। নির্মল সম্পর্কের গুরুত্ব বাড়ে। পরস্পরের মধ্যে অনুপম সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়। মেহমানদারি সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার অন্যতম হাতিয়ার। মেহমানদারিতে আছে আনন্দ ও পুণ্যের দীপাবলি। এটি কল্যাণ ও মহত্ত্বের পরিচায়ক।
ইবরাহিম (আ.) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘‘আমার ফেরেশতারা (পুত্রসন্তানের) সুসংবাদ নিয়ে ইবরাহিমের কাছে এলো। তারা বলল, ‘সালাম।’ সেও বলল, ‘সালাম।’ সে অবিলম্বে কাবাবকৃত গোবৎস (ভুনা গরুর গোশত) নিয়ে এলো।’’ (সুরা হুদ, আয়াত : ৬৯)
সর্বপ্রথম যিনি মেহমানদারির প্রচলন করেন
এই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ইবরাহিম (আ.) মেহমানদারির প্রথা চালু করেছেন। ইসলামে অতিথিসেবার প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মেহমানদারির সঙ্গে ঈমানদারির বিশেষ সম্পর্ক আছে। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহমানকে সম্মান করে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০১৮; মুসলিম, হাদিস : ৪৮)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে প্রেরিত ফেরেশতাদের দলে হজরত জিব্রাইল, মিকাইল ও ইস্রাফিল (আ.) ছিলেন। তারা মানুষের আকৃতি ধারণ করে ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে আগমন করেন। তিনি তাদের মানুষ মনে করে তাদের জন্য আতিথেয়তার আয়োজন করেন। ইবরাহিম (আ.)-ই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম মেহমানদারির প্রথা প্রচলন করেন। (তাফসিরে কুরতুবি)
মেহমানদারির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মহানবী (সা.)
হজরত মুহাম্মদ (সা.) অনেক সময় অতিথি আপ্যায়ন করতে গিয়ে তাকে ও তার পরিবারকে অনাহারে থাকতে হয়েছে। নিজ ঘরে মেহমানদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারলে তিনি মেহমানদের কোনো ধনী সাহাবির বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। নবী হওয়ার আগে থেকেই তিনি অতিথিসেবায় সচেষ্ট ছিলেন।
সর্বপ্রথম ওহিপ্রাপ্ত হয়ে অনেকটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন মহানবী (সা.)। হজরত খাদিজা (রা.) তখন তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন এভাবে—‘আল্লাহর কসম, আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো রক্ষা করেন আত্মীয়তার বন্ধন, বহন করেন অন্যের বোঝা, উপার্জনক্ষম করেন নিঃস্বকে, আহার দেন অতিথিকে, সাহায্য করেন দুর্যোগ-দুর্বিপাকে।’ (বুখারি, হাদিস : ০৩)
আতিথেয়তা নৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে মহৎ কাজ। অতিথিসেবা নবীদের সুন্নাত। কোনো কোনো আলেমের মতে, বহিরাগত মেহমানের মেহমানদারি করা গ্রামবাসীর জন্য ওয়াজিব বা অত্যাবশ্যকীয়। কেননা গ্রামে সাধারণত হোটেলের ব্যবস্থা নেই। তবে শহরে যেহেতু হোটেল-রেস্টুরেন্ট আছে, তাই সে ক্ষেত্রে মেহমানদারি সুন্নাত। (তাফসিরে কুরতুবি)
মেহমানদারির সময় যেসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে
আতিথেয়তা ও মেহমানদারি ইবাদত। মেহমানদারি যদি আল্লাহর হুকুম ও রাসুল (সা.)-এর তরিকায় হয়, তাহলে পার্থিব ও পরকালীন দুই ধরনেই লাভ। মেহমানকে সম্মান জানানো, খুশি করা ও আনন্দিত করার পাশাপাশি বিপুল সওয়াবও লাভ হয়। তাই নিচের বিষয়গুলো খেয়াল রাখা জরুরি-
এক. মেহমান এলে খুব দ্রুত তাকে স্বাগত জানানো
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধিরা মহানবী (সা.)-এর কাছে আগমন করে, মহানবী (সা.) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কারা?’ তারা বলল, ‘আমরা (আবদুল কায়েস গোত্রের) রবিআ শাখার লোক।’ মহানবী (সা.) বললেন, ‘ওই জাতিকে মারহাবা! ওই প্রতিনিধিদলকে মারহাবা! এটা তোমাদের অপরিচিত কোনো জায়গা নয়। এখানে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৩; মুসলিম, হাদিস : ১৭)
দুই. উপস্থিত যা আছে, তা দিয়ে আপ্যায়ন করা
আবদুল্লাহ ইবনে ওবায়েদ ইবনে উমায়ের (রহ.) বলেন, হজরত জাবের (রা.) নবী করিম (সা.)-এর সাহাবিদের এক জামাতের সঙ্গে আমার কাছে তাসরিফ আনলেন। হজরত জাবের (রা.) সঙ্গীদের সামনে রুটি ও সিরকা পেশ করলেন এবং বললেন, “এটা খাও, কেননা আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ইরশাদ করতে শুনেছি, ‘সিরকা’ উত্তম তরকারি। সে ধ্বংস হোক, যে তার কয়েকজন ভাই তার কাছে আসে, আর সে ঘরে যা আছে, তা তাদের সামনে পেশ করাকে কম মনে করে। ওই সব লোক ধ্বংস হোক, যারা তাদের সামনে যা পেশ করা হয়, তারা তাকে তুচ্ছ ও কম মনে করে।” অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘মানুষের ধ্বংসের জন্য এটা যথেষ্ট যে যা তার সামনে পেশ করা হয়, সে তাকে কম মনে করে।’ (মুসনাদে আহমাদ, তাবারানি)
তিন. মেহমানের জন্য বসার আলাদা ব্যবস্থা করা
মেহমান কারো কাছে গিয়ে মেজবানের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসবে না। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কেউ কারো ঘরে গিয়ে তার অনুমতি ছাড়া তার নির্দিষ্ট আসনে বসবে না।’ (মুসলিম, হাদিস : ২৮৩)
চার. আলেম মেহমানকে অত্যধিক সম্মান করা
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘যাদের ধর্মীয় জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদায় উন্নীত করবেন।’ (সুরা মুজাদালা, আয়াত : ১১)
পাঁচ. মেজবান মেহমানদারির কাজে অংশগ্রহণ করা
ইবরাহিম (আ.)-এর ঘটনায় আমরা দেখতে পাই, তিনি নিজেই দ্রুত আগত মেহমানদের জন্য মেহমানদারির ব্যবস্থা করেছেন। তার সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “তোমার কাছে ইবরাহিমের সম্মানিত মেহমানদের কথা পৌঁছেছে কি? যখন তারা তার কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, ‘সালাম।’ জবাবে সেও বলল, ‘সালাম।’ তারা তো (ছিল) অপরিচিত লোক। তারপর ইবরাহিম তার স্ত্রীর কাছে গেল এবং মোটাতাজা গরুর বাছুর ভুনা করে নিয়ে এলো। তারপর তা তাদের সামনে রেখে বলল, ‘তোমরা খাচ্ছ না কেন?’’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত : ২৪-২৭)
ছয়. খাবার নিয়ে লৌকিকতা প্রদর্শন না করা
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আমরা হজরত উমর (রা.)-এর কাছে ছিলাম। তিনি বললেন, ‘আমাদেরকে লৌকিকতা প্রদর্শন করতে নিষেধ করা হয়েছে।’ (বুখারি, হাদিস : ৭২৯৩) অন্য হাদিসে এসেছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘দুজনের খাবার তিনজনের জন্য যথেষ্ট। আর তিনজনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৩৯২, মুসলিম, হাদিস : ২০৫৮)
মেজবানের আদব ও করণীয়
মেহমান পেয়ে মেজবানকে খুশি হতে হবে ও মেহমানকে আল্লাহপাকের নিয়ামত জেনে তার শোকর গুজারি ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে হবে। মেহমানকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে হবে ও উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে হবে। পরিবারের সদস্যদের মেহমানের পরিচয় জানিয়ে দিতে হবে। মেহমানের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো জায়গায় থাকার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে এবং সাধ্যমতো উত্তম পানাহারের আয়োজন করতে হবে। ঠিক খাবারের সময়ে বা খাবারের আগে–পরে নিকটতম সময়ে মেহমান এলে তখন উপস্থিত যা আছে তার মধ্যে উৎকৃষ্ট খাবারটি দিয়ে আপ্যায়ন করতে হবে। মেহমানের অজু-গোসলের ব্যবস্থা ও ইবাদতের সুযোগ করে দিতে হবে। মেহমানের সঙ্গে মাহরাম একত্রে খাওয়াদাওয়া করবেন। বিশেষত পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যদের মেহমানের আগে বা মেহমানকে রেখে আহার না করাই ভালো।
মেহমান যদি এলাকায় নতুন বা অপরিচিত হন, তাহলে স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজনীয় তথ্য মেহমানকে জানাতে হবে। মেহমানের সুবিধা–অসুবিধা ও নিরাপত্তার বিষয় লক্ষ রাখতে হবে। নিজেদের অভাব–অভিযোগ ও সমস্যার কথা মেহমানকে বুঝতে না দেওয়াই ভালো। মেহমানের সামনে নিজেদের মধ্যেও এসব বিষয়ে আলোচনা করা উচিত হবে না। এতে মেহমান বিব্রত বোধ করতে পারেন। এ বিষয়ে কোরআন কারিমে রয়েছে, ‘আর তারা তাদের (মেহমানদের) নিজেদের ওপর প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার দেয়, নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও। যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য হতে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলকাম।’ (সুরা-৫৯ হাশর, আয়াত: ৯)।
মেহমানকে হাদিয়া দেওয়া
বিদায়কালে মেহমানকে কিছু হাদিয়া বা উপঢৌকন দেওয়া যেতে পারে। মেহমানের পথের জন্য পাথেয় বা বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য খাবারদাবার বা অন্য কোনো সামগ্রী উপহার দেওয়া যেতে পারে। যে ঘরে মেহমানের আগমন বেশি হয়, সে ঘরে আল্লাহর রহমতের বর্ষণ বেশি হয়। কারও এটা ভাবা উচিত নয় যে মেহমান আসার কারণে মেজবানের রিজিক কমে যায়। রিজিক কমে যায় না বরং তাদের ভাগ্যে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির আগেই এই রিজিক লিখে রেখেছিলেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, তোমরা তোমাদের অতিথির যথাযথ প্রাপ্য প্রদান করো। মেহমানদের সেবা করা অবশ্যকর্তব্য। এটা আল্লাহ তাআলার আদেশ ও নবীর সুন্নত। (বুখারি ও মুসলিম)
মেহমান এলে বরকত হয়
কেউ যদি বাড়ি নির্মাণ করে, তাহলে সেখানে মেহমানের জন্য বিশেষ ঘর বা কক্ষের ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ হাদিস শরিফে রয়েছে। একজন মেহমান এক গৃহে একবারে তিন দিন থাকার হক বা অধিকার রাখেন।
মেহমানদারিতে রিজিক বৃদ্ধি হয়, উপার্জনে বরকত হয়, ঘরে শান্তি আসে, জীবন সুখের হয়। অতিথি প্রধানত মা–বাবা, ভাই–বোন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া–প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজন বা অপরিচিত লোক এবং মুসাফির ও পথিক। এরা প্রত্যেকেই নৈকট্যের ভিত্তিতে অগ্রাধিকার প্রাপ্য। অতিথি আল্লাহর রহমত নিয়ে আসেন। অতিথির সঙ্গে বরকত আসে। অতিথি মাহরামের দস্তরখানে তার জন্য বরাদ্দকৃত রিজিকই আহার করেন। অতিথির অছিলায় আল্লাহ তাআলা আমাদের রিজিক বৃদ্ধি করে দেন, বিপদ-আপদ দূর করেন ডেইলি বাংলাদেশ