শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদের পদত্যাগের দাবিতে চলা আন্দোলনে ঘি ঢেলেছে ফাঁস হওয়া একটি অডিও ক্লিপ। ইতিমধ্যে তা ভাইরাল। এতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করতে শোনা যায় এক ব্যক্তিকে।
যারা এই অডিওটি ফাঁস করেছেন তাদের দাবি, এটি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের। ছাত্রীদের রাতে বাইরে থাকা নিয়ে কটাক্ষ করছেন উপাচার্য।
বিষয়টি নিয়ে মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে কথা হয় । তারা জানিয়েছেন, অডিওটি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের, তবে এটি ২০১৯ সালের।
তারা জানান, হলের গেট রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা রাখার দাবিতে ২০১৯ সালে ছাত্রীরা আন্দোলন করেছিলেন। তখন আন্দোলনকারী ছাত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে এসব মন্তব্য করেছিলেন উপাচার্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রী জানান, এই অডিও ক্লিপের বক্তব্য শুনেই বোঝা যায়, উপাচার্য কতটা নিচু মানসিকতার। তিনি মেয়েদের প্রতি কী ধারণা পোষণ করেন। তার এই বক্তব্য সব খানে ছড়িয়ে পড়া দরকার। এতে মানুষ বুঝতে পারবে আমরা কেন তার পদত্যাগ চাই।
এই ক্লিপের বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। আন্দোলনকারীরা তাকে বাসভবনে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন। ফোনে যোগাযোগের একাধিক চেষ্টা করা হলেও রিসিভ করেননি তিনি।
ওই ভিডিও ক্লিপ সম্পাদনা করে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের ছবিও যুক্ত করা রয়েছে। উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের কণ্ঠের সঙ্গে মিল রয়েছে এই ক্লিপের।
অডিওতে শোনা যায়, ‘যারা এই ধরনের দাবি তুলেছে, যে বিশ্ববিদ্যালয় সারারাত খোলা রাখতে হবে, এইটা একটা জঘন্য রকম দাবি। আমরা মুখ দেখাইতে পারতাম না। এখানে আমাদের ছাত্রনেতা বলছে যে, জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের সহজে কেউ বউ হিসেবে চায় না। কারণ সারারাত এরা ঘোরাফেরা করে। বাট আমি চাই না যে আমাদের যারা এত ভালো ভালো স্টুডেন্ট, যারা এত সুন্দর, এত সুন্দর ডিপার্টমেন্টগুলো, বিখ্যাত সব শিক্ষক… তারা যাদের গ্র্যাজুয়েট করবে, এরকম একটা কালিমা লেপুক তাদের মধ্যে।
ওই জায়গাটা কেউ চায় না, কোনো গার্ডিয়ানও চান না কিন্তু। এখন আমরা যদি কোনো মেয়েকে বলি তোমার বাবা-মা কাউকে ফোন করব… তখন তোমরাই তো এতে বাধা দিবা… না না না এইটা হবে না, দেখ হয়রানি করতেছে। কিন্তু এইটা তো প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব। তোমাদেরও নৈতিক দায়িত্ব যে, এই মেয়ে কেন রাতের বেলা সোয়া দশটা পর্যন্ত স্যাররে সময় দিসে?’
ওই ক্লিপে আরও শোনা যায়, ‘আমি মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে যখন আসি, রাতে ১২টা-১টা বেজে যায়। আমি দেখি যে আমাদের ওয়ান কিলোমিটার রাস্তা দিয়া ছেলে-মেয়ে হাত ধরাধরি করে কনসালটিং করতাছে। একটা অঘটন ঘটে গেলে দায়দায়িত্ব ভাইস চ্যান্সেলরকে নিতে হবে। যত দোষ, নন্দ ঘোষ। ভাইস চ্যান্সেলর দায়ী সে জন্য।’
বিষয়টি নিয়ে সুলতানা ইয়াসমিন নামের এক ছাত্রী বলেন, ‘এটি উপাচার্যেরই কণ্ঠ। ছাত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে সে দিন তিনি এসব কথা বলেছিলেন।
‘২০১৭ সালে আমরা বিশ্ববিদ্যলয়ের ছাত্রী হল ১০টা পর্যন্ত খোলা রাখার দাবিতে আন্দোলনে নামি। কারণ রাতে আমাদের অনেককে ল্যাবে যেতে হয়। টিউশনি থাকে। ৭টার মধ্যে হলে ফেরা সম্ভব হয় না।’
ইয়াসমিন আরও বলেন, ‘টানা ১৯ দিন আন্দোলন করার পর উপাচার্য তার কার্যালয়ে আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। সেদিন এই কথাগুলো বলেছিলেন।’
এদিকে শাবি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের পদত্যাগের জন্য বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এ সময়ের মধ্যে দাবি না মানা হলে আমরণ অনশনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে মোহাইমিনুল বাশার মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘ভিসি পদত্যাগ না করলে আমরা বুধবার দুপুর ১২টা থেকে আমরণ অনশনে বসব। এর আগ পর্যন্ত আমরা এই অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাব। আমাদের এই আন্দোলন বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়েছে… আমরা আশা করছি শিক্ষার্থীদের এই ক্ষোভ আঁচ করতে পেরে উপাচার্য দ্রুত পদত্যাগ করবেন।’
এই আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হচ্ছে জানিয়ে বাশার বলেন, ‘গুজবে যেন কেউ বিভ্রান্ত না হয়, এই আহ্বান জানাই।’
এর আগে শিক্ষার্থীদের আলোচনার প্রস্তাব দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতারা। তবে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন তারা। শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের আন্দোলনে যারা সংহতি প্রকাশ করবেন কেবল তাদের সঙ্গেই আলোচনা করা হবে।
শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশের করা মামলা প্রত্যাহারে মঙ্গলবার রাত ১০টা পর্যন্ত সময়ও বেঁধে দেন তারা। তবে এ বিষয়ে তারা রাতে আর কিছু জানাননি।
পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল হান্নান সোমবার রাতে বাদী হয়ে সিলেটের জালালাবাদ থানায় এই মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় দু-তিন শ শিক্ষার্থীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
তিন দফা দাবিতে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রোববার সন্ধ্যায় পুলিশের সংঘর্ষ হয়। অবরুদ্ধ উপাচার্যকে মুক্ত করতে গিয়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করলে এই সংঘাত বাধে। এতে পুলিশ, শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ অন্তত ৫০ জন আহত হন।
এ ঘটনার পর তিন দফা দাবির একটি অর্থ্যাৎ বেগম সিরাজুন্নেসা হলের প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবি মেনে নেয়া হয়। রোববার রাতেই প্রভোস্ট জাফরিন আহমেদ লিজা পদত্যাগ করেন।
এরপর শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে নতুন বিক্ষোভ শুরু করেন। তাদের অভিযোগ, উপাচার্যের নির্দেশে পুলিশ তাদের ওপর হামলা ও গুলি করে।
তবে পুলিশের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, রোববার আইআইসিটি ভবনে অবরুদ্ধ উপাচার্যকে উদ্ধার করতে গেলে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ২০০ থেকে ৩০০ ‘উচ্ছৃঙ্খল’ শিক্ষার্থী পুলিশের কাজে বাধা দেয়।
সরকারি আগ্নেয়াস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে ইটপাটকেল ছোড়ে। এ ছাড়া পুলিশকে লক্ষ্য করে শিক্ষার্থীরা গুলি ছোড়ে, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়।
এই মামলায় কাউকে হয়রানি করা হবে না বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেল।
মঙ্গলবার দুপুরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেবে না। এ ছাড়া একটি মামলা হলেও কাউকে হয়রানি করা হবে না।’
এ সময় আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করতে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে যাতে সমাধানে পৌঁছা যায় সেই পথ খোলা রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান নাদেল।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখও জানিয়েছেন, ‘কোনো ঘটনা ঘটলে মামলা করাটা আমাদের রুটিন কাজ। এ জন্য কোনো শিক্ষার্থীকে হয়রানি করা হবে না।’-ডেল্টা টাইমস্

দৈনিক দেশ নিউজ ডটকম ডেস্ক 



















