শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মিয়ানমারের উল্টো দোষারোপ

সীমান্তে গোলাগুলি ও হতাহতের ঘটনার সমাধান খুঁজতে ঢাকা শুরু থেকেই কূটনৈতিক পথে হাঁটলেও গতকাল মঙ্গলবার উল্টো দোষারোপ করে এর দায় আরাকান আর্মি ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসার ওপর চাপিয়েছে মিয়ানমার। একইসঙ্গে এই সংগঠনগুলোর ঘাঁটি বাংলাদেশে রয়েছে বলে দাবি করেছে তারা। এর জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, যখনই বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সম্পর্কিত কোনো বিষয়ের প্রতিবাদ জানায় তখনই মিয়ানমার ‘দুষ্টামি’ করে বানোয়াট কথা বলে ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিতে চায়। মিয়ানমারের এসব ঘটনা ‘নতুন’ নয় বলেও দাবি করেছে বাংলাদেশ। এরকম পরিস্থিতিতে গতকালও তমব্রু, পালংখালি ও উখিয়া সীমান্তে মিয়ানমারের গোলাগুলির ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।

মিয়ানমারের এই দোষারোপের মধ্যেই গতকাল মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদেরকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতির বিষয়ে ব্রিফ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে এদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আহ্বানে উপস্থিত হয়নি মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত চীন। প্রসঙ্গত, এর আগের দিন আসিয়ানভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর কূটনীতিকদের সীমান্ত পরিস্থিতি অবহিত করে ঢাকা।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাউথইস্ট এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক মো. নাজমুল হুদা গতকাল রাতে ভোরের কাগজকে বলেন, মিয়ানমারের ঘটনায় যাতে কোনো ভুল বার্তা তাদের কাছে না যায় সেজন্য আমরা প্রায় সব দেশের কূটনীতিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে চীনের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না বলে দেখেছি। এখন কেন তারা ছিলেন না তা জানতে পারিনি।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চলমান ভূরাজনীতিগত স্বার্থের কারণে কয়েকটি শক্তিশালী দেশের ইন্ধনেই মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে গোলাগুলি করছে। পুরো ঘটনাটিই বৃহত্তর কৌশলগত নানা হিসাব-নিকাশের মধ্যে রয়েছে। এখন শক্তিধর দেশগুলো আবার নানা জোট করেছে। এসব হিসাব-নিকাশের মধ্যে পড়ে বাংলাদেশ ভোগান্তির শিকার হয়েছে।

এদিকে, বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মর্টার শেল ও গোলাবর্ষণে হতাহতের ঘটনার মধ্যে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে জাতিসংঘে চিঠি দিয়েছেন শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। মিয়ানমার থেকে আসা গোলায় এক কিশোর নিহতের ঘটনার তিন দিনের মাথায় সোমবার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের কোণাপাড়া ক্যাম্পের বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খোরশেদ আলম বলেন, মিয়ানমারের আচরণ এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করবে। বাংলাদেশের পশ্চিমে, দক্ষিণে মিয়ানমার আর্মি, উত্তরে আরকান আর্মি। ইচ্ছাকৃত না হলে তাদের গোলা কোনোভাবেই বাংলাদেশে আসার কথা নয়। ইচ্ছাপূর্বক এই কনফ্লিক্টে আমাদের জড়ানোর যে প্রচেষ্টা তাতে জড়িত হব না। তার মতে, আমরা সব ক্ষেত্রেই মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। যাতে করে মিয়ানমার বুঝতে পারে এরকম একটা অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করা তাদের জন্য যেমন বিপজ্জনক তেমনি বাংলাদেশও এটা ভালোভাবে নেবে না।

এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, সীমান্তে এখন মিয়ানমার যেসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তার আশু সমাধান নেই। এটা তাদের অভ্যন্তরীণ ঝামেলা। ওখানে ঝামেলা শেষ হলেই কেবল সমাধান আশা করা যায়। তবু বিষয়টি মিয়ানমারকে ডেকে বারবার বলতে হবে-এই ঘটনায় আমরা প্রভাবিত হচ্ছি, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। প্রয়োজনে জাতিসংঘেও যাওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। অনেকেই বলছেন মিয়ানমারের পেছনে চীনের সমর্থন থাকায় সীমান্তে এসব ঘটছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নেপথ্যে কোনো কলকাঠি নাড়ছে না চীন। খামোখা এই ঘটনায় চীনকে সামনে টেনে আনার দরকার কী। চীন এমনিতেই চাপে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এসব কথা বলা উচিত হবে না। আমাদের যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন তেমনি ভারতেরও প্রয়োজন, আবার চীনেরও প্রয়োজন। কাজেই এসব বিষোদগারের মধ্যে কান না দিয়ে সীমান্তবাসীকে সতর্ক এবং সচেতন করে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশে আরাকান আর্মি ও আরসার ‘ঘাঁটি’ রয়েছে: সীমান্তে মর্টার হামলার দায় আরাকান আর্মি ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসার ওপর চাপিয়েছে মিয়ানমার। একইসঙ্গে এই সংগঠনগুলোর ‘ঘাঁটি’ বাংলাদেশে রয়েছে বলে দাবি করেছে তারা। মিয়ানমার বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যমান সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে চলছে। সোমবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মনজুরুল করিম খান চৌধুরীকে ডেকে নিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে মর্টার হামলার বিষয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক উ জাউ ফিয়ো উইন।

বৈঠকের বিষয়ে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়। পরে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেইসবুক পেইজে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বৈঠকে উ জো ফিয়ো উইন ব্যাখ্যা করে বলেছেন, আরাকান আর্মি ও আরসা বাহিনী গত ১৬ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সীমান্তরক্ষী পুলিশকে লক্ষ্য করে মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। ওই তিনটি মর্টারের গোলা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পড়ে। আরাকান আর্মি ও আরসা ১৭ সেপ্টেম্বরও স্থানীয় সীমান্তরক্ষী পুলিশকে টার্গেট করে হামলা চালায়। সে সময়ও নয়টি মর্টার শেল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পড়ে। বৈঠকে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বিদ্যমান সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য আরাকান আর্মি ও আরসা বাহিনী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ হামলা করছে। উ জো ফিয়ো উইন এসব ঘটনা এড়াতে সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়ে বলেন, মিয়ানমার সবসময়ই দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইন-কানুন মেনে চলে, পাশাপাশি বাংলাদেশসহ সব দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে শ্রদ্ধা করে। সীমান্ত এলাকায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে যাবে বলেও জানান দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ মহাপরিচালক।

অনুপস্থিত চীন: মিয়ানমার ইস্যুতে ঢাকায় দায়িত্বরত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের ব্রিফের জন্য যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তাতে উপস্থিত হয়নি মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র চীন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, বৈঠকে রাশিয়া ও ভারত তাদের প্রতিনিধি পাঠালেও চীনের কোন প্রতিনিধিকে দেখা যায়নি। আরেক কর্মকর্তা জানান, বৈঠকে অংশ নেয়নি মিয়ানমারের ‘অতি ঘনিষ্ঠ ও মদদদাতা’ হিসেবে পরিচিত চীন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় গতকাল বেলা সাড়ে ১০টায় আশিয়ান বহির্ভূত দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বৈঠক শুরু হয়।

এতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খোরশেদ আলম ও সাউথ ইস্ট এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক নাজমুল হুদা। বৈঠক শেষে ১২টার দিকে দূতরা পদ্মা ছাড়তে শুরু করেন। এরপর খোরশেদ আলম জানান, বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মিশর, তুরস্ক, জাপানসহ প্রায় সবাই অংশ নেয়। মিয়ানমারের উসকানিতে পা না দিয়ে বাংলাদেশ ধৈর্য্য পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে এবং এই ইস্যুতে বাংলাদেশ জাতিসংঘে গেলে বাংলাদেশের উদ্যোগকে সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছেন রাষ্ট্রদূতরা। তিনি বলেন, অব্যাহত উসকানিতে মিয়ানমার যাতে ফায়দা নিতে না পারে, এ জন্য রাষ্ট্রদূতের অবহিত করেছে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রদূতরা বলেছেন, তারা ঢাকার অবস্থান তাদের নিজ নিজ সরকারকে জানাবেন। ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, সীমান্তে পরিস্থিতি একই রকম আছে। ওপারে গোলাগুলি থামেনি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নেপিদো যে ব্যখ্যা দিয়েছে সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়।

রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেয়ার অজুহাতের সুযোগ দিতে চাই না: বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে সৃষ্ট উত্তেজনা নিয়ে ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ব্রিফ করার পর ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব খোরশেদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা কূটনীতিকদের সাহায্য চেয়েছি। যাতে মিয়ানমার এ অঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে না পারে। আমরা কোনোভাবেই এখানে জড়িত হতে চাই না। রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেয়ার অজুহাতের সুযোগ মিয়ানমারকে দিতে চাই না। খোরশেদ আলম সাংবাদিকদের জানান, সীামান্তে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, যে প্রাণহানি ঘটছে এবং যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেটি আগেই মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে বলা হয়েছিল। তিনি বলেন, প্রথমেই তাকে ডেকে বলেছিলাম যে আপনারা অ্যাকশন নেন যাতে কোনো ধরনের গোলা আমাদের পাশে না আসে। পরে আমরা আসিয়ান দেশগুলোকে একইভাবে অনুরোধ করেছি আপনারা চেষ্টা করেন মিয়ানমারের গোলা যাতে বাংলাদেশের ওপরে না আসে। আজকে যারা এসেছিলেন অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতেরা, তাদেরকেও বলেছি, গত পাঁচ বছরে তারা একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি। আমরা ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করছি। এমন কিছু করিনি যার জন্য মিয়ানমারের গোলা এসে আমাদের জনগণের নিরাপত্তা ব্যাহত করবে। তারা গরু-বাছুর নিয়ে বাইরে যেতে পারবে না, ধানখেতে যেতে পারবে না, ঘর-বাড়িতে থাকতে পারবে না- এটা তো চলতে দেয়া যায় না।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সর্বাধিক পঠিত

মিয়ানমারের উল্টো দোষারোপ

প্রকাশিত সময় : ১১:০৮:২৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২

সীমান্তে গোলাগুলি ও হতাহতের ঘটনার সমাধান খুঁজতে ঢাকা শুরু থেকেই কূটনৈতিক পথে হাঁটলেও গতকাল মঙ্গলবার উল্টো দোষারোপ করে এর দায় আরাকান আর্মি ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসার ওপর চাপিয়েছে মিয়ানমার। একইসঙ্গে এই সংগঠনগুলোর ঘাঁটি বাংলাদেশে রয়েছে বলে দাবি করেছে তারা। এর জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, যখনই বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সম্পর্কিত কোনো বিষয়ের প্রতিবাদ জানায় তখনই মিয়ানমার ‘দুষ্টামি’ করে বানোয়াট কথা বলে ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিতে চায়। মিয়ানমারের এসব ঘটনা ‘নতুন’ নয় বলেও দাবি করেছে বাংলাদেশ। এরকম পরিস্থিতিতে গতকালও তমব্রু, পালংখালি ও উখিয়া সীমান্তে মিয়ানমারের গোলাগুলির ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।

মিয়ানমারের এই দোষারোপের মধ্যেই গতকাল মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদেরকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতির বিষয়ে ব্রিফ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে এদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আহ্বানে উপস্থিত হয়নি মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত চীন। প্রসঙ্গত, এর আগের দিন আসিয়ানভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর কূটনীতিকদের সীমান্ত পরিস্থিতি অবহিত করে ঢাকা।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাউথইস্ট এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক মো. নাজমুল হুদা গতকাল রাতে ভোরের কাগজকে বলেন, মিয়ানমারের ঘটনায় যাতে কোনো ভুল বার্তা তাদের কাছে না যায় সেজন্য আমরা প্রায় সব দেশের কূটনীতিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে চীনের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না বলে দেখেছি। এখন কেন তারা ছিলেন না তা জানতে পারিনি।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চলমান ভূরাজনীতিগত স্বার্থের কারণে কয়েকটি শক্তিশালী দেশের ইন্ধনেই মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তে গোলাগুলি করছে। পুরো ঘটনাটিই বৃহত্তর কৌশলগত নানা হিসাব-নিকাশের মধ্যে রয়েছে। এখন শক্তিধর দেশগুলো আবার নানা জোট করেছে। এসব হিসাব-নিকাশের মধ্যে পড়ে বাংলাদেশ ভোগান্তির শিকার হয়েছে।

এদিকে, বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মর্টার শেল ও গোলাবর্ষণে হতাহতের ঘটনার মধ্যে নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে জাতিসংঘে চিঠি দিয়েছেন শূন্যরেখায় অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। মিয়ানমার থেকে আসা গোলায় এক কিশোর নিহতের ঘটনার তিন দিনের মাথায় সোমবার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্তের কোণাপাড়া ক্যাম্পের বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খোরশেদ আলম বলেন, মিয়ানমারের আচরণ এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করবে। বাংলাদেশের পশ্চিমে, দক্ষিণে মিয়ানমার আর্মি, উত্তরে আরকান আর্মি। ইচ্ছাকৃত না হলে তাদের গোলা কোনোভাবেই বাংলাদেশে আসার কথা নয়। ইচ্ছাপূর্বক এই কনফ্লিক্টে আমাদের জড়ানোর যে প্রচেষ্টা তাতে জড়িত হব না। তার মতে, আমরা সব ক্ষেত্রেই মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। যাতে করে মিয়ানমার বুঝতে পারে এরকম একটা অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করা তাদের জন্য যেমন বিপজ্জনক তেমনি বাংলাদেশও এটা ভালোভাবে নেবে না।

এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, সীমান্তে এখন মিয়ানমার যেসব ঘটনা ঘটাচ্ছে তার আশু সমাধান নেই। এটা তাদের অভ্যন্তরীণ ঝামেলা। ওখানে ঝামেলা শেষ হলেই কেবল সমাধান আশা করা যায়। তবু বিষয়টি মিয়ানমারকে ডেকে বারবার বলতে হবে-এই ঘটনায় আমরা প্রভাবিত হচ্ছি, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। প্রয়োজনে জাতিসংঘেও যাওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। অনেকেই বলছেন মিয়ানমারের পেছনে চীনের সমর্থন থাকায় সীমান্তে এসব ঘটছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নেপথ্যে কোনো কলকাঠি নাড়ছে না চীন। খামোখা এই ঘটনায় চীনকে সামনে টেনে আনার দরকার কী। চীন এমনিতেই চাপে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এসব কথা বলা উচিত হবে না। আমাদের যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন তেমনি ভারতেরও প্রয়োজন, আবার চীনেরও প্রয়োজন। কাজেই এসব বিষোদগারের মধ্যে কান না দিয়ে সীমান্তবাসীকে সতর্ক এবং সচেতন করে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশে আরাকান আর্মি ও আরসার ‘ঘাঁটি’ রয়েছে: সীমান্তে মর্টার হামলার দায় আরাকান আর্মি ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসার ওপর চাপিয়েছে মিয়ানমার। একইসঙ্গে এই সংগঠনগুলোর ‘ঘাঁটি’ বাংলাদেশে রয়েছে বলে দাবি করেছে তারা। মিয়ানমার বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যমান সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করতে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে চলছে। সোমবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মনজুরুল করিম খান চৌধুরীকে ডেকে নিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে মর্টার হামলার বিষয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক উ জাউ ফিয়ো উইন।

বৈঠকের বিষয়ে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয়। পরে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেইসবুক পেইজে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বৈঠকে উ জো ফিয়ো উইন ব্যাখ্যা করে বলেছেন, আরাকান আর্মি ও আরসা বাহিনী গত ১৬ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সীমান্তরক্ষী পুলিশকে লক্ষ্য করে মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। ওই তিনটি মর্টারের গোলা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পড়ে। আরাকান আর্মি ও আরসা ১৭ সেপ্টেম্বরও স্থানীয় সীমান্তরক্ষী পুলিশকে টার্গেট করে হামলা চালায়। সে সময়ও নয়টি মর্টার শেল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পড়ে। বৈঠকে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বিদ্যমান সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করার জন্য আরাকান আর্মি ও আরসা বাহিনী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ হামলা করছে। উ জো ফিয়ো উইন এসব ঘটনা এড়াতে সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়ে বলেন, মিয়ানমার সবসময়ই দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইন-কানুন মেনে চলে, পাশাপাশি বাংলাদেশসহ সব দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে শ্রদ্ধা করে। সীমান্ত এলাকায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করে যাবে বলেও জানান দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ মহাপরিচালক।

অনুপস্থিত চীন: মিয়ানমার ইস্যুতে ঢাকায় দায়িত্বরত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের ব্রিফের জন্য যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তাতে উপস্থিত হয়নি মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র চীন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, বৈঠকে রাশিয়া ও ভারত তাদের প্রতিনিধি পাঠালেও চীনের কোন প্রতিনিধিকে দেখা যায়নি। আরেক কর্মকর্তা জানান, বৈঠকে অংশ নেয়নি মিয়ানমারের ‘অতি ঘনিষ্ঠ ও মদদদাতা’ হিসেবে পরিচিত চীন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় গতকাল বেলা সাড়ে ১০টায় আশিয়ান বহির্ভূত দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বৈঠক শুরু হয়।

এতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খোরশেদ আলম ও সাউথ ইস্ট এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক নাজমুল হুদা। বৈঠক শেষে ১২টার দিকে দূতরা পদ্মা ছাড়তে শুরু করেন। এরপর খোরশেদ আলম জানান, বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলো ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মিশর, তুরস্ক, জাপানসহ প্রায় সবাই অংশ নেয়। মিয়ানমারের উসকানিতে পা না দিয়ে বাংলাদেশ ধৈর্য্য পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে এবং এই ইস্যুতে বাংলাদেশ জাতিসংঘে গেলে বাংলাদেশের উদ্যোগকে সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছেন রাষ্ট্রদূতরা। তিনি বলেন, অব্যাহত উসকানিতে মিয়ানমার যাতে ফায়দা নিতে না পারে, এ জন্য রাষ্ট্রদূতের অবহিত করেছে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রদূতরা বলেছেন, তারা ঢাকার অবস্থান তাদের নিজ নিজ সরকারকে জানাবেন। ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, সীমান্তে পরিস্থিতি একই রকম আছে। ওপারে গোলাগুলি থামেনি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নেপিদো যে ব্যখ্যা দিয়েছে সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়।

রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেয়ার অজুহাতের সুযোগ দিতে চাই না: বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে সৃষ্ট উত্তেজনা নিয়ে ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ব্রিফ করার পর ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব খোরশেদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা কূটনীতিকদের সাহায্য চেয়েছি। যাতে মিয়ানমার এ অঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে না পারে। আমরা কোনোভাবেই এখানে জড়িত হতে চাই না। রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেয়ার অজুহাতের সুযোগ মিয়ানমারকে দিতে চাই না। খোরশেদ আলম সাংবাদিকদের জানান, সীামান্তে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, যে প্রাণহানি ঘটছে এবং যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেটি আগেই মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে বলা হয়েছিল। তিনি বলেন, প্রথমেই তাকে ডেকে বলেছিলাম যে আপনারা অ্যাকশন নেন যাতে কোনো ধরনের গোলা আমাদের পাশে না আসে। পরে আমরা আসিয়ান দেশগুলোকে একইভাবে অনুরোধ করেছি আপনারা চেষ্টা করেন মিয়ানমারের গোলা যাতে বাংলাদেশের ওপরে না আসে। আজকে যারা এসেছিলেন অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতেরা, তাদেরকেও বলেছি, গত পাঁচ বছরে তারা একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি। আমরা ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করছি। এমন কিছু করিনি যার জন্য মিয়ানমারের গোলা এসে আমাদের জনগণের নিরাপত্তা ব্যাহত করবে। তারা গরু-বাছুর নিয়ে বাইরে যেতে পারবে না, ধানখেতে যেতে পারবে না, ঘর-বাড়িতে থাকতে পারবে না- এটা তো চলতে দেয়া যায় না।