বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বাড়ল ইরান-সৌদি উত্তেজনা

ইরান ও সৌদি আরবের দ্ব›দ্বকে মধ্যপ্রাচ্যের শীতল যুদ্ধ বলা হলেও আঞ্চলিক আধিপত্য, ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক প্রভাবের কারণে তা আর শীতল থাকছে না। উত্তাপের পারদ ক্রমেই এখন উপরে চড়ছে। সৌদি আরব ও তার মিত্রদের জন্য মার্কিন সমর্থন আর ইরান ও মিত্রদের প্রতি চীন-রাশিয়ার সমর্থন স্নায়ুযুদ্ধের উনুনে লাকড়ির জোগান দিচ্ছে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ঐতিহাসিকভাবে সৌদি আরব একটি রাজতন্ত্র এবং ইসলামের জন্মস্থান। তারা নিজেদের মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে দেখছিল ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের আগ পর্যন্ত। আরব-ইরানি সংঘাতের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতার শুরু ১৯৭০ এর পর থেকে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে, সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে একাধিক ঘটনার পর্যবেক্ষণে বিভেদের চূড়ান্ত পর্যায় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনে সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রতিপক্ষ সরে যায়। তখন থেকেই দেশটিতে ইরানি প্রভাব বাড়ছে। ২০১১-এর দিকে আরব বসন্তের মাতাল হাওয়া আরব বিশ্বে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছিল। ইরান ও সৌদি আরব এই উত্থান বা পরিবর্তনকে কাজে লাগিয়েছে। বিশেষ করে সিরিয়া, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে পারষ্পরিক সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ইরানের সমালোচকরা বলছেন, সমগ্র ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত স্থল করিডরের নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশে ইরান তখন থেকেই মরিয়া হয়ে উঠেছে।

সৌদি আরবের শঙ্কা : ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, মার্কিন ও সৌদি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে যে, ইরানের সাম্প্রতিক বিক্ষোভে সহায়তা করার জন্য প্রতিশোধ নিতে মার্কিন, ইসরায়েলি বা সৌদি লক্ষ্যবস্তুতে ইরান আক্রমণ করতে পারে। বিশেষ করে এরবিল ও আল হারি বিমানবন্দর মূল টার্গেট। এ কারণেই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ, আরব লীগ, উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ এবং অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন (ওআইসি)-ও বলছে সৌদি আরব যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শঙ্কা প্রকাশ করেছে তা উদ্বেগজনক।

মার্কিন প্রতিক্রিয়া : উদ্বেগ নিয়ে বসে নেই মার্কিনিরা। তাদের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেছে, আমরা হুমকি নিয়ে উদ্বিগ্ন। সৌদি আরবের সঙ্গে সামরিক ও গোয়েন্দা যোগাযোগ রাখছি। আমরা এই অঞ্চলে আমাদের অংশীদারদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে দ্বিধা করব না।

ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া : ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি গত বুধবার এই প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এটিকে ভিত্তিহীন এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে তেহরানের সম্পর্ক নষ্ট করার হীন ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেছে। ইরানের অভিযোগ, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে দেশটিতে চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পেছনে সৌদি আরব এবং অন্যান্য প্রতিদ্ব›দ্বী সক্রিয় রয়েছে। অক্টোবরে ইরানের ইসলামিক রেভেল্যুশনারি গার্ড কর্পসের কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেন সালামি সৌদি আরবকে বলেন, এটি আমাদের শেষ সতর্কবার্তা। কারণ মিডিয়ার মাধ্যমে আপনি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন।

টানাপড়েনের সম্পর্ক : সৌদি নেতৃত্বাধীন ওপেক জোট গত মাসে তেল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার পর রিয়াদ এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে টানাপড়েনের সম্পর্কের সময়ে সর্বশেষ উদ্বেগগুলো এসেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পেট্রলের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি করেছে। ২০১৯ সালে সৌদি আরবে একটি বড় হামলার পেছনে ইরানকে দোষারোপ করেছে মার্কিনিরা যা অস্বীকার করেছে ইরান। ধারণা করা হচ্ছে, সৌদি আরব এবারো তেল কমানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কারণেই মার্কিনীরা আগাম ইরানি হামলার তথ্য নিয়ে এসেছে উত্তেজনার পারদ চড়াতে।

কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা : এরইমধ্যে লেবাননে ইরানের মিত্র শিয়া মিলিশিয়া গ্রুপ হিজবুল্লাহ ও একটি রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ব্লকের নেতৃত্ব দেয় ইরান। তা ছাড়া বিভিন্ন উপায়ে আঞ্চলিক লড়াইয়ে জয়লাভ করছে ইরান। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের প্রতি ইরানি সমর্থন সৌদি সমর্থিত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে অনেকাংশে পরাস্ত করতে সক্ষম করেছে। যা সৌদির তরুণ এবং আবেগপ্রবণ ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সামরিক প্রতিশোধপরায়নতা ও আঞ্চলিক উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তুলছে।

সৌদি আরব কি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে যাবে : পেন্টাগনের মুখপাত্র বিমান বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার মো. জেনারেল প্যাট্রিক রাইডার ওয়াশিংটনের একটি ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ইরান যে কোনো সময় সৌদি আরবে হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। গত মঙ্গলবার তিন মার্কিন কর্মকর্তা তা নিশ্চিত করেছেন। একজন কর্মকর্তা একে শিগগিরই বা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণের হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সর্বাধিক পঠিত

মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বাড়ল ইরান-সৌদি উত্তেজনা

প্রকাশিত সময় : ১২:০৪:০০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ নভেম্বর ২০২২

ইরান ও সৌদি আরবের দ্ব›দ্বকে মধ্যপ্রাচ্যের শীতল যুদ্ধ বলা হলেও আঞ্চলিক আধিপত্য, ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক প্রভাবের কারণে তা আর শীতল থাকছে না। উত্তাপের পারদ ক্রমেই এখন উপরে চড়ছে। সৌদি আরব ও তার মিত্রদের জন্য মার্কিন সমর্থন আর ইরান ও মিত্রদের প্রতি চীন-রাশিয়ার সমর্থন স্নায়ুযুদ্ধের উনুনে লাকড়ির জোগান দিচ্ছে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ঐতিহাসিকভাবে সৌদি আরব একটি রাজতন্ত্র এবং ইসলামের জন্মস্থান। তারা নিজেদের মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে দেখছিল ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের আগ পর্যন্ত। আরব-ইরানি সংঘাতের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতার শুরু ১৯৭০ এর পর থেকে। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে, সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে একাধিক ঘটনার পর্যবেক্ষণে বিভেদের চূড়ান্ত পর্যায় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনে সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রতিপক্ষ সরে যায়। তখন থেকেই দেশটিতে ইরানি প্রভাব বাড়ছে। ২০১১-এর দিকে আরব বসন্তের মাতাল হাওয়া আরব বিশ্বে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছিল। ইরান ও সৌদি আরব এই উত্থান বা পরিবর্তনকে কাজে লাগিয়েছে। বিশেষ করে সিরিয়া, বাহরাইন এবং ইয়েমেনে পারষ্পরিক সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ইরানের সমালোচকরা বলছেন, সমগ্র ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত স্থল করিডরের নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশে ইরান তখন থেকেই মরিয়া হয়ে উঠেছে।

সৌদি আরবের শঙ্কা : ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে, মার্কিন ও সৌদি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে যে, ইরানের সাম্প্রতিক বিক্ষোভে সহায়তা করার জন্য প্রতিশোধ নিতে মার্কিন, ইসরায়েলি বা সৌদি লক্ষ্যবস্তুতে ইরান আক্রমণ করতে পারে। বিশেষ করে এরবিল ও আল হারি বিমানবন্দর মূল টার্গেট। এ কারণেই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ, আরব লীগ, উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ এবং অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন (ওআইসি)-ও বলছে সৌদি আরব যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শঙ্কা প্রকাশ করেছে তা উদ্বেগজনক।

মার্কিন প্রতিক্রিয়া : উদ্বেগ নিয়ে বসে নেই মার্কিনিরা। তাদের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেছে, আমরা হুমকি নিয়ে উদ্বিগ্ন। সৌদি আরবের সঙ্গে সামরিক ও গোয়েন্দা যোগাযোগ রাখছি। আমরা এই অঞ্চলে আমাদের অংশীদারদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে দ্বিধা করব না।

ইরানের পাল্টা প্রতিক্রিয়া : ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি গত বুধবার এই প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এটিকে ভিত্তিহীন এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে তেহরানের সম্পর্ক নষ্ট করার হীন ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেছে। ইরানের অভিযোগ, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে দেশটিতে চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পেছনে সৌদি আরব এবং অন্যান্য প্রতিদ্ব›দ্বী সক্রিয় রয়েছে। অক্টোবরে ইরানের ইসলামিক রেভেল্যুশনারি গার্ড কর্পসের কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেন সালামি সৌদি আরবকে বলেন, এটি আমাদের শেষ সতর্কবার্তা। কারণ মিডিয়ার মাধ্যমে আপনি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন।

টানাপড়েনের সম্পর্ক : সৌদি নেতৃত্বাধীন ওপেক জোট গত মাসে তেল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার পর রিয়াদ এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে টানাপড়েনের সম্পর্কের সময়ে সর্বশেষ উদ্বেগগুলো এসেছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পেট্রলের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি করেছে। ২০১৯ সালে সৌদি আরবে একটি বড় হামলার পেছনে ইরানকে দোষারোপ করেছে মার্কিনিরা যা অস্বীকার করেছে ইরান। ধারণা করা হচ্ছে, সৌদি আরব এবারো তেল কমানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কারণেই মার্কিনীরা আগাম ইরানি হামলার তথ্য নিয়ে এসেছে উত্তেজনার পারদ চড়াতে।

কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা : এরইমধ্যে লেবাননে ইরানের মিত্র শিয়া মিলিশিয়া গ্রুপ হিজবুল্লাহ ও একটি রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ব্লকের নেতৃত্ব দেয় ইরান। তা ছাড়া বিভিন্ন উপায়ে আঞ্চলিক লড়াইয়ে জয়লাভ করছে ইরান। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের প্রতি ইরানি সমর্থন সৌদি সমর্থিত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে অনেকাংশে পরাস্ত করতে সক্ষম করেছে। যা সৌদির তরুণ এবং আবেগপ্রবণ ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সামরিক প্রতিশোধপরায়নতা ও আঞ্চলিক উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তুলছে।

সৌদি আরব কি ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে যাবে : পেন্টাগনের মুখপাত্র বিমান বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার মো. জেনারেল প্যাট্রিক রাইডার ওয়াশিংটনের একটি ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ইরান যে কোনো সময় সৌদি আরবে হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। গত মঙ্গলবার তিন মার্কিন কর্মকর্তা তা নিশ্চিত করেছেন। একজন কর্মকর্তা একে শিগগিরই বা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণের হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।