শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গ্যাস বাবুর ভাষ্যে ফাঁসছেন অনেকে

ঝিনাইদহ-৪  আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডে আটক জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুর দেওয়া তথ্যে অনেকে ফেঁসে যাচ্ছেন। পুলিশের একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে এ তথ্য জানিয়েছে। ঘটনার অন্যতম নায়ক আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়ার আত্মীয় গ্যাস বাবু। তিনি জানিয়েছেন, ঢাকায় কামরুজ্জামানের গুলশানের বাসায় কয়েক দফা বৈঠক হয়েছিল।

যতই দিন যাচ্ছে ততই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের তদন্তকারী সংস্থাগুলো নিশ্চিত হয়েছে, চোরাচালান এবং রাজনৈতিক কারণে আনারকে হত্যা করা হয়েছে। কারা এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সে ব্যাপারেও অনেকটা নিশ্চিত পুলিশ। ঝিনাইদহ ও যশোরের ছয়জন ‘প্রভাবশালী’ ব্যক্তি গোয়েন্দাদের নজরে আছেন। তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

আনারকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছে কসাই সিয়াম। তার ভাষ্য শুনে কলকাতা পুলিশ হতবাক। কলকাতা পুলিশও নিশ্চিত হয়েছে, স্যুয়ারেজ লাইন থেকে উদ্ধার হওয়া মাংসখন্ড মানুষেরই। দুয়েক দিনের মধ্যে আনারের মেয়ে ডরিনের ডিএনএ পরীক্ষা সম্পন্ন হবে।

সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, ১২ মে আনার কলকাতায় যাওয়ার পরের দিনই তাকে ব্যবসার কথা বলে নিউ টাউন এলাকার একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে যায় হত্যা-পরিকল্পনাকারীরা। তিনি কলকাতায় যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে থেকেই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আনারের বাল্যবন্ধু আখতারুজ্জামান শাহীন কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। চিহ্নিত ফ্ল্যাটে প্রবেশের ৩০ মিনিটের মাথায় তাকে হত্যা করা হয়। এর আগে মিনিট দশেক চোরাচালানসহ নানা বিষয়ে হত্যাকারীদের সঙ্গে আনারের তর্কাতর্কি হয়, অশালীন বাক্য বিনিময়ও হয়।

নাম প্রকাশ না করে  ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, “চোরাচালান ও স্থানীয় রাজনৈতিক কারণে আনারকে হত্যা করা হয়েছে। এক বছর ধরে আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এ বিষয়ে  ঢাকা, ঝিনাইদহ ও যশোরে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। কারা হত্যা করবে তার তালিকাও তৈরি করে পরিকল্পনাকারীরা। ওইসব বৈঠকে আখতারুজ্জামানসহ ছয়জন ‘প্রভাবশালী’ ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তাদের নাম জানা গেছে। আওয়ামী লীগ নেতা বাবুর মোবাইলে ফোনে সব তথ্য পাওয়া গেছে। বাবু জিজ্ঞাসাবাদেও তথ্য দিয়ে চলেছেন। তারা মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করেছেন। ‘রাজনৈতিক কাঁটা’ দূর হবে এ আশায় এমপিকে হত্যা করা হয়।”

ওই কর্মকর্তা জানান, ওইসব প্রভাবশালীকে আমাদের জালে আনা হয়েছে। দ্রুতই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কলকাতার সঞ্জিভা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটে আনারকে হত্যা এবং লাশ গুমের পর ১৫ মে বাংলাদেশে ফেরেন শিমুল ভূঁইয়া। আখতারুজ্জামান শাহীন শিমুলকে জানান, বাবুর কাছ থেকে টাকা নাও। ১৬ মে বাবুর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেন শিমুল। ১৭ মে তারা ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে গাড়ির ভেতরে সাক্ষাৎ করেন। বাবু বলেন, ২৩ মে টাকা দেবেন। কিন্তু তার আগেই হত্যার কথা চাউর হয়ে গেলে তারা আত্মগোপনে চলে যান।

পুলিশ সূত্র জানায়, যশোরের শার্শা, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, কালীগঞ্জ, শৈলকুপার সীমান্ত এলাকার চোরাচালানসহ সব কারবারের একক নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিলেন যশোরের আলোচিত এক প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার আধিপত্য বিস্তারে বাধা হয়ে দাঁড়ান এমপি আনার। ফলে তাকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।  ঢাকার একজন হীরা ব্যবসায়ী ও একজন ডেভেলপারও হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে ইঙ্গিত মিলেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার নামও জানা গেছে। গ্যাস বাবু বেশ কয়েকজনের নাম বলেছেন। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে তিনি তার দুটি আইফোন ভেঙে ফেলেন। পরে মোবাইলগুলো হারিয়ে গেছে বলে ঝিনাইদহ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। সন্দেহ দেখা দিলে সদর থানা-পুলিশ  ঢাকার ডিবি পুলিশকে জানায়।

আনার হত্যার ঘটনার তদন্ত শেষে অনেকেই গ্রেপ্তার হতে পারেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সত্যের কাছাকাছি এসে গেছি। মরদেহের বিষয়টি নিশ্চিত হলেই আমরা আপনাদের কাছে অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারব। যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের জবানবন্দি শুনেছি। মাংসখন্ডগুলো কোথায় তারা রেখেছে তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। আমাদের গোয়েন্দারা ভারতে গিয়েছিল। তারা যে খন্ড গুলো পেয়েছেন, সেগুলো উদ্ধার করেছেন। ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া নিশ্চিত হওয়া যাবে না এগুলো আনারের মরদেহের অংশ কি না।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সর্বাধিক পঠিত

গ্যাস বাবুর ভাষ্যে ফাঁসছেন অনেকে

প্রকাশিত সময় : ১০:১৫:০১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ জুন ২০২৪

ঝিনাইদহ-৪  আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ডে আটক জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুর দেওয়া তথ্যে অনেকে ফেঁসে যাচ্ছেন। পুলিশের একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে এ তথ্য জানিয়েছে। ঘটনার অন্যতম নায়ক আমানুল্লাহ ওরফে শিমুল ভূঁইয়ার আত্মীয় গ্যাস বাবু। তিনি জানিয়েছেন, ঢাকায় কামরুজ্জামানের গুলশানের বাসায় কয়েক দফা বৈঠক হয়েছিল।

যতই দিন যাচ্ছে ততই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের তদন্তকারী সংস্থাগুলো নিশ্চিত হয়েছে, চোরাচালান এবং রাজনৈতিক কারণে আনারকে হত্যা করা হয়েছে। কারা এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সে ব্যাপারেও অনেকটা নিশ্চিত পুলিশ। ঝিনাইদহ ও যশোরের ছয়জন ‘প্রভাবশালী’ ব্যক্তি গোয়েন্দাদের নজরে আছেন। তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

আনারকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে তার বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছে কসাই সিয়াম। তার ভাষ্য শুনে কলকাতা পুলিশ হতবাক। কলকাতা পুলিশও নিশ্চিত হয়েছে, স্যুয়ারেজ লাইন থেকে উদ্ধার হওয়া মাংসখন্ড মানুষেরই। দুয়েক দিনের মধ্যে আনারের মেয়ে ডরিনের ডিএনএ পরীক্ষা সম্পন্ন হবে।

সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, ১২ মে আনার কলকাতায় যাওয়ার পরের দিনই তাকে ব্যবসার কথা বলে নিউ টাউন এলাকার একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে যায় হত্যা-পরিকল্পনাকারীরা। তিনি কলকাতায় যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে থেকেই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আনারের বাল্যবন্ধু আখতারুজ্জামান শাহীন কলকাতায় অবস্থান করছিলেন। চিহ্নিত ফ্ল্যাটে প্রবেশের ৩০ মিনিটের মাথায় তাকে হত্যা করা হয়। এর আগে মিনিট দশেক চোরাচালানসহ নানা বিষয়ে হত্যাকারীদের সঙ্গে আনারের তর্কাতর্কি হয়, অশালীন বাক্য বিনিময়ও হয়।

নাম প্রকাশ না করে  ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, “চোরাচালান ও স্থানীয় রাজনৈতিক কারণে আনারকে হত্যা করা হয়েছে। এক বছর ধরে আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এ বিষয়ে  ঢাকা, ঝিনাইদহ ও যশোরে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। কারা হত্যা করবে তার তালিকাও তৈরি করে পরিকল্পনাকারীরা। ওইসব বৈঠকে আখতারুজ্জামানসহ ছয়জন ‘প্রভাবশালী’ ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তাদের নাম জানা গেছে। আওয়ামী লীগ নেতা বাবুর মোবাইলে ফোনে সব তথ্য পাওয়া গেছে। বাবু জিজ্ঞাসাবাদেও তথ্য দিয়ে চলেছেন। তারা মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করেছেন। ‘রাজনৈতিক কাঁটা’ দূর হবে এ আশায় এমপিকে হত্যা করা হয়।”

ওই কর্মকর্তা জানান, ওইসব প্রভাবশালীকে আমাদের জালে আনা হয়েছে। দ্রুতই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কলকাতার সঞ্জিভা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটে আনারকে হত্যা এবং লাশ গুমের পর ১৫ মে বাংলাদেশে ফেরেন শিমুল ভূঁইয়া। আখতারুজ্জামান শাহীন শিমুলকে জানান, বাবুর কাছ থেকে টাকা নাও। ১৬ মে বাবুর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেন শিমুল। ১৭ মে তারা ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে গাড়ির ভেতরে সাক্ষাৎ করেন। বাবু বলেন, ২৩ মে টাকা দেবেন। কিন্তু তার আগেই হত্যার কথা চাউর হয়ে গেলে তারা আত্মগোপনে চলে যান।

পুলিশ সূত্র জানায়, যশোরের শার্শা, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, কালীগঞ্জ, শৈলকুপার সীমান্ত এলাকার চোরাচালানসহ সব কারবারের একক নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিলেন যশোরের আলোচিত এক প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার আধিপত্য বিস্তারে বাধা হয়ে দাঁড়ান এমপি আনার। ফলে তাকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।  ঢাকার একজন হীরা ব্যবসায়ী ও একজন ডেভেলপারও হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে ইঙ্গিত মিলেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার নামও জানা গেছে। গ্যাস বাবু বেশ কয়েকজনের নাম বলেছেন। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে তিনি তার দুটি আইফোন ভেঙে ফেলেন। পরে মোবাইলগুলো হারিয়ে গেছে বলে ঝিনাইদহ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। সন্দেহ দেখা দিলে সদর থানা-পুলিশ  ঢাকার ডিবি পুলিশকে জানায়।

আনার হত্যার ঘটনার তদন্ত শেষে অনেকেই গ্রেপ্তার হতে পারেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা সত্যের কাছাকাছি এসে গেছি। মরদেহের বিষয়টি নিশ্চিত হলেই আমরা আপনাদের কাছে অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারব। যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের জবানবন্দি শুনেছি। মাংসখন্ডগুলো কোথায় তারা রেখেছে তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। আমাদের গোয়েন্দারা ভারতে গিয়েছিল। তারা যে খন্ড গুলো পেয়েছেন, সেগুলো উদ্ধার করেছেন। ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া নিশ্চিত হওয়া যাবে না এগুলো আনারের মরদেহের অংশ কি না।’