ফেসবুকে বিতর্কিত পোস্ট দেওয়ার পর লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) তাপসী তাবাসসুমকে (ঊর্মি) ওএসডি করার পর এবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকাল সোমবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে এসব সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এর আগে গত রবিবার তাপসী তাবাসসুমকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছিল। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কেউ কেউ বলছেন, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে ঊর্মির বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছে সরকার। তবে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, ফেসবুকে দেওয়া তার পোস্ট একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সরকারি কর্মচারী হিসেবে তিনি অপরাধ করেছেন
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাকস্বাধীনতা মানেই যা ইচ্ছে বলা বা করা যায় না। এ ছাড়া একজন সাধারণ মানুষ নানা রকম মন্তব্য করা বা বক্তব্য দিতে পারলেও দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিবিধি অনুযায়ী অনেক কিছুই বলার সুযোগ নেই। এমনকি ঊর্মি যে দপ্তরে কর্মরত ছিলেন, সেখানকার কোনো তথ্য জানাতেও তার ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল।
অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে নিজের ফেসবুক পেজে সম্প্রতি একটি পোস্ট করেন তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি। এ ছাড়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের সমালোচনা করেও নিজের ফেসবুক পেজে এর আগে পোস্ট দেন তিনি। যা নিয়ে দু-তিন দিন ধরে দেশ জুড়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এরই মধ্যে গত রবিবার ঊর্মিকে ওএসডি করার পরদিন গতকাল তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। কী কারণে তাকে ওএসডি করা হয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে সেটির উল্লেখ নেই। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষপর্যায়ের একজনের বক্তব্যকে কটাক্ষ ও সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার কারণেই মূলত ঊর্মির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক ভিত্তি আছে কী নেই, সেটা বলার অধিকার একজন সরকারি কর্মচারী বা কর্মকর্তার নেই। এটা সাধারণ মানুষ কিংবা অন্য পেশার মানুষ বলতে পারেন। তাকে (ঊর্মি) এটা বলার আগে চিন্তা করা দরকার ছিল। তা ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর রাষ্ট্রীয় নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে। প্রধান বিচারপতিও এটার আইনগত বৈধতা দিয়েছেন। এগুলো জানার পরও একজন গণকর্মচারীর এ ধরনের মন্তব্য করা অপরাধ।’
অবশ্য ঊর্মিকে ওএসডি করার পরদিনই সাময়িক বরখাস্ত করার মতো কঠোর সিদ্ধান্তের পক্ষে নন এই জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘তাকে প্রথমে যে ওএসডি করা হয়েছিল, সেটাই ভালো ছিল। কিন্তু এরপর তাকে বরখাস্ত করাটা কঠোর হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে ওএসডি করার পর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা ও তদন্তের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া ভালো ছিল বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি।’
গত রবিবার ঊর্মিকে ওএসডি করে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে বদলি করা হয়। ওইদিন রাতে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে রিলিজ দেওয়া হয় তাকে।
আলোচিত-সমালোচিত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে লিখেছেলেন, ‘সাংবিধানিক ভিত্তিহীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, রিসেট বাটনে পুশ করা হয়েছে। অতীত মুছে গেছে। রিসেট বাটনে ক্লিক করে দেশের সব অতীত ইতিহাস মুছে ফেলেছেন তিনি। এতই সহজ! কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে আপনার, মহাশয়।’
‘তবে একটা বিষয়ে আপনাকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার আপনাদের এই সেøাগানটা যে অক্ষরে অক্ষরে সত্য ছিল সেটা এত সময়ে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার করে দিয়েছেন…’ লিখেছেন ঊর্মি।
সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার পর গতকাল তাপসী তাবাসসুম ঊর্মির মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ না করায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট লক (বন্ধু তালিকার বাইরে কেউ প্রবেশ করার সুযোগ নেই) থাকায় পোস্টগুলো যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
তবে এর আগে তাপসী তাবাসসসুম ঊর্মি সাংবাদিকদের কাছে অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি পোস্ট দিয়েছি এটাই তো যথেষ্ট। অনলি মি (তিনি ছাড়া আর কেউ পোস্টটি এখন আর দেখতে পারবেন না) করেছি। বদলি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর জন্য যদি আমার চাকরি চলে যায়, সমস্যা নেই। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, এটা মীমাংসিত সত্য। রিসেট বাটন মুছে ফেলে অতীত মুছে ফেলা, এর মানে কী? তাহলে তো আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি আমাদের দেশে সরকার হিসেবে আছে। আমার মনে হয়েছে, আমার দায়িত্বশীল জায়গা এটাই। বলা হচ্ছে জুলাই গণহত্যা, এগুলো সবই তদন্তসাপেক্ষ, মীমাংসিত সত্য না। এখন পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি তো।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিহত আবু সাঈদকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে ঊর্মি লেখেন, ‘কত বড় বোকার স্বর্গে আছি, এইটা শুধু চিন্তা করি। আবু সাঈদ! বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, সন্ত্রাসী একটা ছেলে, যে কি না বিশৃঙ্খলা করতে গিয়ে নিজের দলের লোকের হাতেই মারা পড়ল; সে নাকি শহীদ! এটাও এখন মানা লাগবে!’
আবু সাঈদের বাড়িতে যাওয়ায় প্রধান উপদেষ্টার সমালোচনা করে তিনি আরও লেখেন, ‘এই আহাম্মকি ভ্রমণের জন্য এত বড় গাড়িবহর পুরো বিভাগ থেকে যে গেল, তার তেল খরচ কে দিয়েছে?’
এর পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের আগে ও পরে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে ঊর্মি তার ফেসবুক পেজে একাধিক স্ট্যাটাস দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে আবু সাঈদকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়ার প্রতিবাদ এবং তাপসী তাবাসসসুম ঊর্মিকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করতে গতকাল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আলটিমেটাম দেয়। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তা করা না হলে ‘উত্তরবঙ্গ ব্লকেড’ এবং ‘লংমার্চ টু রংপুর বিভাগীয় কমিশনার’ কর্মসূচি দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়। সে সময় পেরোনোর আগেই তাপসী তাবাসসুম ঊর্মিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর সহকারী কমিশনার হিসেবে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসনে যোগ দেন ঊর্মি। তিনি নেত্রকোনার পূর্বধলা সদর ইউনিয়নের নসিবপুর গ্রামের মো. ইসমাইল হোসেনের মেয়ে। তার বাবা ময়মনসিংহ আনন্দমোহন সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করতেন। বর্তমানে তিনি অবসর জীবনযাপন করছেন। গ্রামের বাড়ি নসিবপুর হলেও ইসমাইল হোসেন ময়মনসিংহে থাকেন। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে ঊর্মি সবার বড়।
গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের অনুগত কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে সেখানে ব্যাপক রদবদল হচ্ছে। এই রদবদলের মধ্যেই অন্তত তিনজন সচিবকে নতুন করে নিয়োগ দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ ‘অনুগত’ হিসেবে আবার তাদের প্রত্যাহারের ঘটনাও ঘটেছে।

ডেইলি দেশ নিউজ ডটকম ডেস্ক 

























