মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মাতৃত্বের শক্তিতে বিশ্বজয়

আজ বিশ্ব মা দিবস। এই বিশেষ দিনে আমরা আমাদের জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। পৃথিবীর কিছু মাকে নিয়ে এই লেখা। লিখেছেন নীল সায়ন

চিরাচরিত মাতৃরূপের বাইরেও ইতিহাসে এমন অনেক মহীয়সী নারী নিজেদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন, যাদের অবদান কোনো অংশে কম নয়। তারা শুধু কোনো সন্তানের জননী ছিলেন না, বরং বৃহত্তর অর্থে সমাজ, শিক্ষা, প্রগতি ও মানবতার ‘মা’ রূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। অথচ, কালের গর্ভে তাদের আসল নাম চাপা পড়ে গেছে, অথবা তারা কেবল স্নেহপূর্ণ ডাকনামেই পরিচিত হয়ে রয়েছেন। আসুন, বিশ্ব মা দিবসের এই আবহে তেমনই কিছু বিস্মৃত অথচ প্রভাবশালী নারীদের জীবন ও কর্মের দিকে আলোকপাত করি।

‘কে চালায় বিশ্ব? নারীরা।’ সংগীতশিল্পী ও পপ তারকা বিয়ন্সের এই গানের কথাগুলো সেইসব নির্ভীক নারীদের প্রতি উৎসর্গীকৃত, যারা সমাজের সব বাধা অতিক্রম করে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করেছেন। আজ, বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজত্ব করা অনেক বিখ্যাত মা তরুণ প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয়। এই সফল মায়েরা প্রমাণ করেছেন যে পরিবার সামলেও ক্যারিয়ার গড়া এবং নিজেদের মতামত জোরালোভাবে প্রকাশ করা সম্ভব। বিশ্ব মা দিবসের প্রাক্কালে, আসুন আমরা তেমনই কিছু বিখ্যাত এবং সাহসী মায়ের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করি।

পথ দেখায় মা

মেরি কুরি, যিনি দুটি ভিন্ন বিষয়ে (পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন) একমাত্র মহিলা নোবেল বিজয়ী; মেরি ওলস্টোনক্রাফট, নারীবাদী লেখিকা যার কন্যা মেরি শেলি ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’-এর মতো বিখ্যাত উপন্যাস লিখেছেন; কিংবা অ্যান মরো লিন্ডবার্গ, ছয় সন্তানের জননী, লেখিকা ও বিমানচালক এরা প্রত্যেকেই মাতৃত্বের পাশাপাশি নিজেদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন।দেশ রূপান্তর

বিশ্ব মা দিবসের ধারণাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছিল এবং প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার এটি পালিত হয়। ফিলাডেলফিয়ার বাসিন্দা আনা জার্ভিস ১৯০৭ সালের ১২ মে পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় তার প্রয়াত মায়ের জন্য একটি স্মরণসভা আয়োজন করার মাধ্যমে এর সূচনা করেন। তার মা স্বাস্থ্য, সম্প্রীতি ও বন্ধুত্ব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নারী সংগঠন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। শিগগিরই মা দিবসের উদযাপন অন্যান্য আমেরিকান রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৯১৪ সালে রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন এটিকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। এই বছর ১৪ মে বিশ্ব জুড়ে এই দিনটি পালিত হবে।

এই মা দিবসে, আসুন আমরা তেমনই কিছু শক্তিশালী মায়ের দিকে নজর দিই :

জে কে রাউলিং : ‘হ্যারি পটার’ সিরিজের লেখিকা জে কে রাউলিং শিশুদের মনে জাদুবিশ্বের প্রতি বিশ্বাস জাগিয়ে তোলার জন্য চিরকাল স্মরণীয় থাকবেন। এক সময়ের কঠিন জীবন সংগ্রাম এবং সিঙ্গল মাদার হিসেবে কন্যাকে মানুষ করার অভিজ্ঞতা তাকে আরও শক্তিশালী করেছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ‘লুমোস’ নামক একটি আন্তর্জাতিক শিশু দাতব্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা।

মিশেল ওবামা : আমেরিকার প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নারীদের স্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছেন। শিশুদের স্বাস্থ্য ও অধিকারের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। দুই কন্যার জননী মিশেল তার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মজীবনের পাশাপাশি পরিবারকে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন।

বিয়ন্সে : বিশ্ব জুড়ে সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে ঝড় তোলা বিয়ন্সে কেবল একজন শিল্পী নন, একজন সফল মা-ও। ২৮টি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী এই তারকা মঞ্চ, রেড কার্পেট এবং সংগীত জগতে নিজের স্বতন্ত্র স্থান তৈরি করেছেন। তিন সন্তানের জননী বিয়ন্সে মাতৃত্বের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজের সংগীত ক্যারিয়ারকেও সাফল্যের শিখরে নিয়ে গেছেন।

জাসিন্ডা আর্ডার্ন : নিউজিল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডার্ন বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছেন যে মা হওয়ার পরেও সবকিছু সম্ভব। ৩৮ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী হওয়া এই নেত্রী কর্মজীবনে থাকাকালে সন্তানের জন্ম দেওয়া বিশ্বের দ্বিতীয় মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান। মাতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়া এবং তার সঙ্গীকে গৃহস্থালির দায়িত্বে উৎসাহিত করার মাধ্যমে তিনি প্রথাগত লিঙ্গ ভূমিকার বাইরে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

ফাল্গুনী নায়ার : স্বনির্মিত বিলিয়নিয়ার উদ্যোক্তা ফাল্গুনী নায়ার বিনিয়োগ ব্যাংকার থেকে ব্যবসায়ী হয়ে ‘নাইকা’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা ভারতের বৃহত্তম ক্রমবর্ধমান সৌন্দর্য ও ফ্যাশন অনলাইন রিটেল প্ল্যাটফর্ম। দুই সন্তানের জননী ফাল্গুনী কর্মজীবনের পাশাপাশি সন্তানদেরও ব্যবসায় যুক্ত করেছেন এবং দেশের প্রথম মহিলা-নেতৃত্বাধীন ইউনিকর্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন।

উরসুলা ভন ডার লেইন : ইউরোপীয় কমিশনের প্রথম মহিলা সভাপতি উরসুলা ভন ডার লেইন সাত সন্তানের জননী। কর্মজীবনে ‘ওয়ার্কাহোলিক’ হিসেবে পরিচিত উরসুলা ‘কনজারভেটিভ ফেমিনিজম’-এর ধারণা প্রবর্তন করেন এবং ‘মাতৃত্বকালীন ছুটি’-র পরিবর্তে ‘পিতামাতার ছুটি’ শব্দটি ব্যবহার করেন।

ফাতিমা আল-ফিহরি

নবম শতাব্দীর মরক্কোয় যখন জ্ঞানচর্চা সীমিত ছিল, তখন এক মহীয়সী নারীশিক্ষার দিগন্তে এক নতুন সূর্যোদয় ঘটান। তিনি হলেন ফাতিমা আল-ফিহরি। ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মরক্কোর ফেজ শহরে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম আল-কারাউইয়িন। এই বিদ্যাপীঠ শুধু মুসলিম বিশ্বেই নয়, সমগ্র বিশ্বে জ্ঞান বিতরণের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত এবং ধর্মতত্ত্বের মতো বিষয়ে এখানে দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনের জন্য আসতেন। শিক্ষা বিস্তারে নারীর ভূমিকা নিয়ে যখন আজও সমাজে নানা বিতর্ক বিদ্যমান, তখন এক সহস্রাব্দেরও বেশি সময় আগে ফাতিমা আল-ফিহরির এই অসামান্য কীর্তি নারীশক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অথচ, ইতিহাসের পাতায় তার নাম ততটা উজ্জ্বলভাবে লেখা হয়নি যতটা তার অবদান দাবি রাখে।

সোকোজান মাই : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল, তার মর্মান্তিক স্মৃতি আজও বিশ্ববাসীকে ব্যথিত করে। এই ধ্বংসযজ্ঞের পর শান্তির বার্তা নিয়ে যিনি বিশ্বজুড়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তিনি হলেন সোকোজান মাই। জাপানি শিশুরা তাকে ‘মাই সোকোজান’ বা ‘শান্তির মা’ নামে ডাকত। তিনি যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের এক শক্তিশালী কণ্ঠস্বর ছিলেন এবং পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। মায়ের স্নেহ ও ভালোবাসার মতো শান্তির বার্তা তিনি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তার জীবন যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে শান্তির আশার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বেগম রোকেয়া : উনিশ শতকের শেষভাগ ও বিশ শতকের শুরুতে ভারতীয় উপমহাদেশে নারীশিক্ষা ও অধিকারের জন্য যিনি অক্লান্ত সংগ্রাম করে গেছেন, তিনি হলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তিনি শুধু নারীশিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধিই করেননি, বরং মুসলিম নারীদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করে তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ‘সুলতানার স্বপ্ন’-এর মতো কালজয়ী রচনা দিয়ে তিনি নারী স্বাধীনতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। সমাজের কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক আপসহীন যোদ্ধা। বেগম রোকেয়া ছিলেন সেই ভবিষ্যতের ‘মা’, যিনি শুধু সন্তান জন্ম দেননি, বরং একটি পিছিয়ে পড়া সমাজকে প্রগতির পথে চালিত করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। এই মহীয়সী নারীরা শুধু জৈবিক অর্থে মাতা ছিলেন না। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে এমন অবদান রেখেছেন যা একটি সমাজ, একটি প্রজন্ম বা একটি জাতির লালন-পালন ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

চলচ্চিত্রে মাতৃত্ব

বিশ্ব চলচ্চিত্রে মাকে কেন্দ্র করে নির্মিত বহু অমর ছবি আজও দর্শকদের হৃদয়ে গভীর ছাপ রেখে চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে মা-মেয়ের বেঁচে থাকার লড়াই নিয়ে ভিত্তোরিও দ্য সিকার কালজয়ী ছবি টু উইমেন-এ ফুটে উঠেছে মানবতা, মাতৃত্ব আর সাহসের অনুপম এক আলেখ্য। কিংবদন্তি সোফিয়া লরেনের অসাধারণ অভিনয় এই ছবিকে চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।

একইভাবে, টার্মস অফ এনডিয়ারমেন্ট ছবিতে মায়ের কণ্ঠে জীবনের পরিপার্শ্বিকতার ভেতরেও এক নিঃশর্ত ভালোবাসার করুণ রসদ মেলে। আকিলাহ অ্যান্ড দ্য বি-তে ফুটে ওঠে শিক্ষার আলোর পথে সন্তানের পাশে দাঁড়ানো এক সংগ্রামী মায়ের প্রেরণা। দ্য ব্লাইন্ড সাইড ছবিতে বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কীভাবে ভালোবাসা ও সাহচর্য একজন পথহারা কিশোরকে পৌঁছে দিতে পারে সাফল্যের শিখরে।

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটেও মা-কে ঘিরে তৈরি হয়েছে অনেক শক্তিশালী ও আবেগঘন চলচ্চিত্র। যেমন, শক্তি : দ্য পাওয়ার ছবিতে কারিশমা কাপুর এক মায়ের ভূমিকায় যে সংগ্রামের চিত্র এঁকেছেন, তা বিস্ময় জাগায়। জাজবা ছবিতে ঐশ্বরিয়া রায়ের চরিত্রটি দেখিয়ে দেয়, সন্তানকে রক্ষার জন্য একজন মা কতদূর যেতে পারেন। বাংলা চলচ্চিত্রে সুচিত্রা সেন অভিনীত উত্তর ফাল্গুনী ছবিটি মা এবং সন্তানের জীবনের দ্বৈত সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি। আর বাংলাদেশের দর্শকপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে উঠে আসে আম্মাজান যেখানে এক মা নিজের সন্তান ও সমাজের জন্য রীতিমতো এক প্রতীক হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশে আরও বহু চলচ্চিত্রে মাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে হৃদয়স্পর্শী গল্প যেমন শিবলী সাদিকের ‘মায়ের অধিকার’, দেলোয়ার হোসেন দুলালের ‘বড় মা’, আওকাত হোসেনের ‘মায়ের দাবি’, দীলিপ বিশ্বাসের ‘মায়ের মর্যাদা’, কিংবা এফআই মানিকের ‘মায়ের হাতে বেহেশতের চাবি’। প্রতিটি ছবির কেন্দ্রে রয়েছে মা যিনি নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে সন্তানের জীবন গড়ে তোলেন।

সাহিত্যে মাতৃত্ব

অন্যদিকে বিশ্বসাহিত্যে মায়ের উপস্থিতি এক নীরব অথচ শক্তিশালী শক্তি হিসেবে বারবার ফিরে আসে। খালেদ হোসেইনির আ থাউজ্যান্ড স্পেøনডিড সানস-এ আফগান সমাজে নারীর অস্তিত্ব আর মাতৃত্বের যুদ্ধ এক মর্মস্পর্শী কাহিনিতে রূপ নিয়েছে। টোনি মরিসনের বিলাভড-এ আফ্রিকান আমেরিকান দাসপ্রথার পরিপ্রেক্ষিতে এক মায়ের অতিপ্রাকৃত সংগ্রামের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে ইতিহাস ও মাতৃত্বের ভয়াবহতা। এমা ডনাহুর রুম-এ একজন বন্দিনী মায়ের সন্তানকে মুক্তির স্বপ্ন দেখানোর গল্প হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দেয়। একইভাবে অ্যামি ট্যান-এর দ্য জয় লাক ক্লাব-এ চীনা আমেরিকান মায়েদের অভিজ্ঞতা ও তাদের মেয়েদের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক নানা স্তরে মায়ের পরিচয়কে ব্যাখ্যা করে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু, ঝুলন্ত  লাশ উদ্ধার

মাতৃত্বের শক্তিতে বিশ্বজয়

প্রকাশিত সময় : ০৫:৪৮:০০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১১ মে ২০২৫

আজ বিশ্ব মা দিবস। এই বিশেষ দিনে আমরা আমাদের জন্মদাত্রী মায়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। পৃথিবীর কিছু মাকে নিয়ে এই লেখা। লিখেছেন নীল সায়ন

চিরাচরিত মাতৃরূপের বাইরেও ইতিহাসে এমন অনেক মহীয়সী নারী নিজেদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন, যাদের অবদান কোনো অংশে কম নয়। তারা শুধু কোনো সন্তানের জননী ছিলেন না, বরং বৃহত্তর অর্থে সমাজ, শিক্ষা, প্রগতি ও মানবতার ‘মা’ রূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। অথচ, কালের গর্ভে তাদের আসল নাম চাপা পড়ে গেছে, অথবা তারা কেবল স্নেহপূর্ণ ডাকনামেই পরিচিত হয়ে রয়েছেন। আসুন, বিশ্ব মা দিবসের এই আবহে তেমনই কিছু বিস্মৃত অথচ প্রভাবশালী নারীদের জীবন ও কর্মের দিকে আলোকপাত করি।

‘কে চালায় বিশ্ব? নারীরা।’ সংগীতশিল্পী ও পপ তারকা বিয়ন্সের এই গানের কথাগুলো সেইসব নির্ভীক নারীদের প্রতি উৎসর্গীকৃত, যারা সমাজের সব বাধা অতিক্রম করে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করেছেন। আজ, বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজত্ব করা অনেক বিখ্যাত মা তরুণ প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয়। এই সফল মায়েরা প্রমাণ করেছেন যে পরিবার সামলেও ক্যারিয়ার গড়া এবং নিজেদের মতামত জোরালোভাবে প্রকাশ করা সম্ভব। বিশ্ব মা দিবসের প্রাক্কালে, আসুন আমরা তেমনই কিছু বিখ্যাত এবং সাহসী মায়ের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করি।

পথ দেখায় মা

মেরি কুরি, যিনি দুটি ভিন্ন বিষয়ে (পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন) একমাত্র মহিলা নোবেল বিজয়ী; মেরি ওলস্টোনক্রাফট, নারীবাদী লেখিকা যার কন্যা মেরি শেলি ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’-এর মতো বিখ্যাত উপন্যাস লিখেছেন; কিংবা অ্যান মরো লিন্ডবার্গ, ছয় সন্তানের জননী, লেখিকা ও বিমানচালক এরা প্রত্যেকেই মাতৃত্বের পাশাপাশি নিজেদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন।দেশ রূপান্তর

বিশ্ব মা দিবসের ধারণাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছিল এবং প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার এটি পালিত হয়। ফিলাডেলফিয়ার বাসিন্দা আনা জার্ভিস ১৯০৭ সালের ১২ মে পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় তার প্রয়াত মায়ের জন্য একটি স্মরণসভা আয়োজন করার মাধ্যমে এর সূচনা করেন। তার মা স্বাস্থ্য, সম্প্রীতি ও বন্ধুত্ব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নারী সংগঠন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। শিগগিরই মা দিবসের উদযাপন অন্যান্য আমেরিকান রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৯১৪ সালে রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন এটিকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। এই বছর ১৪ মে বিশ্ব জুড়ে এই দিনটি পালিত হবে।

এই মা দিবসে, আসুন আমরা তেমনই কিছু শক্তিশালী মায়ের দিকে নজর দিই :

জে কে রাউলিং : ‘হ্যারি পটার’ সিরিজের লেখিকা জে কে রাউলিং শিশুদের মনে জাদুবিশ্বের প্রতি বিশ্বাস জাগিয়ে তোলার জন্য চিরকাল স্মরণীয় থাকবেন। এক সময়ের কঠিন জীবন সংগ্রাম এবং সিঙ্গল মাদার হিসেবে কন্যাকে মানুষ করার অভিজ্ঞতা তাকে আরও শক্তিশালী করেছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ‘লুমোস’ নামক একটি আন্তর্জাতিক শিশু দাতব্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা।

মিশেল ওবামা : আমেরিকার প্রাক্তন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নারীদের স্বপ্ন দেখার সাহস জুগিয়েছেন। শিশুদের স্বাস্থ্য ও অধিকারের জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। দুই কন্যার জননী মিশেল তার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মজীবনের পাশাপাশি পরিবারকে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন।

বিয়ন্সে : বিশ্ব জুড়ে সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে ঝড় তোলা বিয়ন্সে কেবল একজন শিল্পী নন, একজন সফল মা-ও। ২৮টি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী এই তারকা মঞ্চ, রেড কার্পেট এবং সংগীত জগতে নিজের স্বতন্ত্র স্থান তৈরি করেছেন। তিন সন্তানের জননী বিয়ন্সে মাতৃত্বের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজের সংগীত ক্যারিয়ারকেও সাফল্যের শিখরে নিয়ে গেছেন।

জাসিন্ডা আর্ডার্ন : নিউজিল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডার্ন বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছেন যে মা হওয়ার পরেও সবকিছু সম্ভব। ৩৮ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী হওয়া এই নেত্রী কর্মজীবনে থাকাকালে সন্তানের জন্ম দেওয়া বিশ্বের দ্বিতীয় মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান। মাতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়া এবং তার সঙ্গীকে গৃহস্থালির দায়িত্বে উৎসাহিত করার মাধ্যমে তিনি প্রথাগত লিঙ্গ ভূমিকার বাইরে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

ফাল্গুনী নায়ার : স্বনির্মিত বিলিয়নিয়ার উদ্যোক্তা ফাল্গুনী নায়ার বিনিয়োগ ব্যাংকার থেকে ব্যবসায়ী হয়ে ‘নাইকা’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা ভারতের বৃহত্তম ক্রমবর্ধমান সৌন্দর্য ও ফ্যাশন অনলাইন রিটেল প্ল্যাটফর্ম। দুই সন্তানের জননী ফাল্গুনী কর্মজীবনের পাশাপাশি সন্তানদেরও ব্যবসায় যুক্ত করেছেন এবং দেশের প্রথম মহিলা-নেতৃত্বাধীন ইউনিকর্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন।

উরসুলা ভন ডার লেইন : ইউরোপীয় কমিশনের প্রথম মহিলা সভাপতি উরসুলা ভন ডার লেইন সাত সন্তানের জননী। কর্মজীবনে ‘ওয়ার্কাহোলিক’ হিসেবে পরিচিত উরসুলা ‘কনজারভেটিভ ফেমিনিজম’-এর ধারণা প্রবর্তন করেন এবং ‘মাতৃত্বকালীন ছুটি’-র পরিবর্তে ‘পিতামাতার ছুটি’ শব্দটি ব্যবহার করেন।

ফাতিমা আল-ফিহরি

নবম শতাব্দীর মরক্কোয় যখন জ্ঞানচর্চা সীমিত ছিল, তখন এক মহীয়সী নারীশিক্ষার দিগন্তে এক নতুন সূর্যোদয় ঘটান। তিনি হলেন ফাতিমা আল-ফিহরি। ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মরক্কোর ফেজ শহরে প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম আল-কারাউইয়িন। এই বিদ্যাপীঠ শুধু মুসলিম বিশ্বেই নয়, সমগ্র বিশ্বে জ্ঞান বিতরণের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত এবং ধর্মতত্ত্বের মতো বিষয়ে এখানে দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনের জন্য আসতেন। শিক্ষা বিস্তারে নারীর ভূমিকা নিয়ে যখন আজও সমাজে নানা বিতর্ক বিদ্যমান, তখন এক সহস্রাব্দেরও বেশি সময় আগে ফাতিমা আল-ফিহরির এই অসামান্য কীর্তি নারীশক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অথচ, ইতিহাসের পাতায় তার নাম ততটা উজ্জ্বলভাবে লেখা হয়নি যতটা তার অবদান দাবি রাখে।

সোকোজান মাই : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল, তার মর্মান্তিক স্মৃতি আজও বিশ্ববাসীকে ব্যথিত করে। এই ধ্বংসযজ্ঞের পর শান্তির বার্তা নিয়ে যিনি বিশ্বজুড়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তিনি হলেন সোকোজান মাই। জাপানি শিশুরা তাকে ‘মাই সোকোজান’ বা ‘শান্তির মা’ নামে ডাকত। তিনি যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের এক শক্তিশালী কণ্ঠস্বর ছিলেন এবং পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। মায়ের স্নেহ ও ভালোবাসার মতো শান্তির বার্তা তিনি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তার জীবন যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে শান্তির আশার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বেগম রোকেয়া : উনিশ শতকের শেষভাগ ও বিশ শতকের শুরুতে ভারতীয় উপমহাদেশে নারীশিক্ষা ও অধিকারের জন্য যিনি অক্লান্ত সংগ্রাম করে গেছেন, তিনি হলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তিনি শুধু নারীশিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধিই করেননি, বরং মুসলিম নারীদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করে তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ‘সুলতানার স্বপ্ন’-এর মতো কালজয়ী রচনা দিয়ে তিনি নারী স্বাধীনতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। সমাজের কুসংস্কার ও অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন এক আপসহীন যোদ্ধা। বেগম রোকেয়া ছিলেন সেই ভবিষ্যতের ‘মা’, যিনি শুধু সন্তান জন্ম দেননি, বরং একটি পিছিয়ে পড়া সমাজকে প্রগতির পথে চালিত করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। এই মহীয়সী নারীরা শুধু জৈবিক অর্থে মাতা ছিলেন না। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে এমন অবদান রেখেছেন যা একটি সমাজ, একটি প্রজন্ম বা একটি জাতির লালন-পালন ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

চলচ্চিত্রে মাতৃত্ব

বিশ্ব চলচ্চিত্রে মাকে কেন্দ্র করে নির্মিত বহু অমর ছবি আজও দর্শকদের হৃদয়ে গভীর ছাপ রেখে চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে মা-মেয়ের বেঁচে থাকার লড়াই নিয়ে ভিত্তোরিও দ্য সিকার কালজয়ী ছবি টু উইমেন-এ ফুটে উঠেছে মানবতা, মাতৃত্ব আর সাহসের অনুপম এক আলেখ্য। কিংবদন্তি সোফিয়া লরেনের অসাধারণ অভিনয় এই ছবিকে চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।

একইভাবে, টার্মস অফ এনডিয়ারমেন্ট ছবিতে মায়ের কণ্ঠে জীবনের পরিপার্শ্বিকতার ভেতরেও এক নিঃশর্ত ভালোবাসার করুণ রসদ মেলে। আকিলাহ অ্যান্ড দ্য বি-তে ফুটে ওঠে শিক্ষার আলোর পথে সন্তানের পাশে দাঁড়ানো এক সংগ্রামী মায়ের প্রেরণা। দ্য ব্লাইন্ড সাইড ছবিতে বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কীভাবে ভালোবাসা ও সাহচর্য একজন পথহারা কিশোরকে পৌঁছে দিতে পারে সাফল্যের শিখরে।

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটেও মা-কে ঘিরে তৈরি হয়েছে অনেক শক্তিশালী ও আবেগঘন চলচ্চিত্র। যেমন, শক্তি : দ্য পাওয়ার ছবিতে কারিশমা কাপুর এক মায়ের ভূমিকায় যে সংগ্রামের চিত্র এঁকেছেন, তা বিস্ময় জাগায়। জাজবা ছবিতে ঐশ্বরিয়া রায়ের চরিত্রটি দেখিয়ে দেয়, সন্তানকে রক্ষার জন্য একজন মা কতদূর যেতে পারেন। বাংলা চলচ্চিত্রে সুচিত্রা সেন অভিনীত উত্তর ফাল্গুনী ছবিটি মা এবং সন্তানের জীবনের দ্বৈত সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি। আর বাংলাদেশের দর্শকপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে সর্বাগ্রে উঠে আসে আম্মাজান যেখানে এক মা নিজের সন্তান ও সমাজের জন্য রীতিমতো এক প্রতীক হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশে আরও বহু চলচ্চিত্রে মাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে হৃদয়স্পর্শী গল্প যেমন শিবলী সাদিকের ‘মায়ের অধিকার’, দেলোয়ার হোসেন দুলালের ‘বড় মা’, আওকাত হোসেনের ‘মায়ের দাবি’, দীলিপ বিশ্বাসের ‘মায়ের মর্যাদা’, কিংবা এফআই মানিকের ‘মায়ের হাতে বেহেশতের চাবি’। প্রতিটি ছবির কেন্দ্রে রয়েছে মা যিনি নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে সন্তানের জীবন গড়ে তোলেন।

সাহিত্যে মাতৃত্ব

অন্যদিকে বিশ্বসাহিত্যে মায়ের উপস্থিতি এক নীরব অথচ শক্তিশালী শক্তি হিসেবে বারবার ফিরে আসে। খালেদ হোসেইনির আ থাউজ্যান্ড স্পেøনডিড সানস-এ আফগান সমাজে নারীর অস্তিত্ব আর মাতৃত্বের যুদ্ধ এক মর্মস্পর্শী কাহিনিতে রূপ নিয়েছে। টোনি মরিসনের বিলাভড-এ আফ্রিকান আমেরিকান দাসপ্রথার পরিপ্রেক্ষিতে এক মায়ের অতিপ্রাকৃত সংগ্রামের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে ইতিহাস ও মাতৃত্বের ভয়াবহতা। এমা ডনাহুর রুম-এ একজন বন্দিনী মায়ের সন্তানকে মুক্তির স্বপ্ন দেখানোর গল্প হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দেয়। একইভাবে অ্যামি ট্যান-এর দ্য জয় লাক ক্লাব-এ চীনা আমেরিকান মায়েদের অভিজ্ঞতা ও তাদের মেয়েদের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক নানা স্তরে মায়ের পরিচয়কে ব্যাখ্যা করে।