রবিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক মতভিন্নতা, কঠিন চ্যালেঞ্জে সরকার

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে এ নির্বাচনের আয়োজন নিয়ে সরকারের সামনে তৈরি হয়েছে একের পর এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন অবস্থান, আন্তর্জাতিক চাপ, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে সরকারের জন্য এখন যেন এক জটিল সমীকরণ।

কেননা নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভাজনের তীব্রতা এরইমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিএনপি সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতরে থেকেই নির্বাচনে যেতে রাজি হলেও সুষ্ঠু পরিবেশ” নিশ্চিত করার শর্ত দিচ্ছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী সরাসরি বলছে, জুলাই সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনে গণভোট ছাড়া তারা নির্বাচনে আস্থা রাখবে না। এনসিপি চাইছে নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন।

অর্থাৎ—সরকারকে একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হচ্ছে ভিন্নমুখী অন্তত তিনটি রাজনৈতিক প্রস্তাব। এর মধ্যে একটি দল গণভোটের কথা বলছে, আরেক দল গণপরিষদ নির্বাচন চাইছে, আরেক দল চাইছে সাংবিধানিক কাঠামো বজায় রেখেই নির্বাচনের অঙ্গীকার। ফলে সরকারের জন্য একক সমাধান বের করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

 

এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে বিরোধী দলের সমাবেশে হামলা, সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হকের ওপর হামলার ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতা ঠেকাতে না পারলে নির্বাচনের পরিবেশ প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। এছাড়া প্রশাসনের ভেতরেও বিভক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। নির্বাচনকালে মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে ভোটের দিন মাঠপর্যায়ে সামান্য শিথিলতাও সারা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেরও কড়া নজর রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যেই অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের সমালোচনা করছে। সরকার যদি সব দলকে আস্থায় আনতে ব্যর্থ হয়, তবে নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্ন উঠতে পারে—যা সরাসরি অর্থনীতি ও কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে।

এদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ, মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের সংকট এবং বিনিয়োগ স্থবিরতা—সবই নির্বাচনী পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ আরও কমে যেতে পারে। ফলে সরকারকে একই সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার লড়াই চালাতে হচ্ছে।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন—এখন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি করানো। যদি কোনো একটি বড় দল নির্বাচন বর্জন করে, তবে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতা দেওয়া কঠিন হবে। অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াত বা এনসিপির ভিন্ন শর্ত মেনে নিলে আবার সাংবিধানিক কাঠামোর সঙ্কট তৈরি হবে।

 

সবমিলিয়ে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে সরকার এখন চারদিক থেকে চাপে রয়েছে। এরমধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের শর্ত, সহিংসতার ঝুঁকি, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার প্রশ্ন, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও চাপ, এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ইস্যুগুলো মূখ্য হয়েছে দাঁড়িয়েছে। এমন বাস্তবতায় সরকারের সামনে একদিকে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে সব দলের আস্থা অর্জনের কঠিন দায়িত্ব। রাজনৈতিক অচলাবস্থা এড়াতে সরকার কীভাবে এই জটিল সমীকরণ সমাধান করে—সেটিই এখন সময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক মতভিন্নতা, কঠিন চ্যালেঞ্জে সরকার

প্রকাশিত সময় : ০৯:৩৩:২৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে এ নির্বাচনের আয়োজন নিয়ে সরকারের সামনে তৈরি হয়েছে একের পর এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন অবস্থান, আন্তর্জাতিক চাপ, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে সরকারের জন্য এখন যেন এক জটিল সমীকরণ।

কেননা নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভাজনের তীব্রতা এরইমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিএনপি সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতরে থেকেই নির্বাচনে যেতে রাজি হলেও সুষ্ঠু পরিবেশ” নিশ্চিত করার শর্ত দিচ্ছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী সরাসরি বলছে, জুলাই সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনে গণভোট ছাড়া তারা নির্বাচনে আস্থা রাখবে না। এনসিপি চাইছে নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন।

অর্থাৎ—সরকারকে একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হচ্ছে ভিন্নমুখী অন্তত তিনটি রাজনৈতিক প্রস্তাব। এর মধ্যে একটি দল গণভোটের কথা বলছে, আরেক দল গণপরিষদ নির্বাচন চাইছে, আরেক দল চাইছে সাংবিধানিক কাঠামো বজায় রেখেই নির্বাচনের অঙ্গীকার। ফলে সরকারের জন্য একক সমাধান বের করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

 

এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে বিরোধী দলের সমাবেশে হামলা, সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হকের ওপর হামলার ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতা ঠেকাতে না পারলে নির্বাচনের পরিবেশ প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। এছাড়া প্রশাসনের ভেতরেও বিভক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। নির্বাচনকালে মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে ভোটের দিন মাঠপর্যায়ে সামান্য শিথিলতাও সারা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেরও কড়া নজর রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যেই অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের সমালোচনা করছে। সরকার যদি সব দলকে আস্থায় আনতে ব্যর্থ হয়, তবে নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্ন উঠতে পারে—যা সরাসরি অর্থনীতি ও কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে।

এদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ, মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের সংকট এবং বিনিয়োগ স্থবিরতা—সবই নির্বাচনী পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ আরও কমে যেতে পারে। ফলে সরকারকে একই সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার লড়াই চালাতে হচ্ছে।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন—এখন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি করানো। যদি কোনো একটি বড় দল নির্বাচন বর্জন করে, তবে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে আন্তর্জাতিকভাবে বৈধতা দেওয়া কঠিন হবে। অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াত বা এনসিপির ভিন্ন শর্ত মেনে নিলে আবার সাংবিধানিক কাঠামোর সঙ্কট তৈরি হবে।

 

সবমিলিয়ে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে সরকার এখন চারদিক থেকে চাপে রয়েছে। এরমধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের শর্ত, সহিংসতার ঝুঁকি, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার প্রশ্ন, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও চাপ, এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ইস্যুগুলো মূখ্য হয়েছে দাঁড়িয়েছে। এমন বাস্তবতায় সরকারের সামনে একদিকে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে সব দলের আস্থা অর্জনের কঠিন দায়িত্ব। রাজনৈতিক অচলাবস্থা এড়াতে সরকার কীভাবে এই জটিল সমীকরণ সমাধান করে—সেটিই এখন সময়ের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।