রবিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

হঠাৎই শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, এর কী প্রভাব পড়তে পারে দেশের রাজনীতিতে?

চলতি সপ্তাহে ঢাকায় দুইটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষ ঘিরে রাজনীতিতে অস্থিরতার মধ্যে হঠাৎই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের শিক্ষাঙ্গন। আলাদা আলাদা ইস্যুকে কেন্দ্র করে রোববার তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা ও সংঘর্ষের পর দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে।

এসব ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ কেন বা কি কারণে এমন অশান্ত হয়ে উঠলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো।

দেশের রাজনীতিতে নানা ইস্যুতে অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে ক্যাম্পাসগুলোও অশান্ত হয়ে ওঠার বিষয়গুলো নিয়ে নানা আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

বিশেষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় গ্রামবাসীর সংঘর্ষের পর ক্যাম্পাসে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় এখনো ১৪৪ ধারা বলবৎ রয়েছে।

এদিকে, তিন দফা দাবিতে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও সংঘর্ষের জের ধরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা ও আবাসিক হল খালি করার ঘোষণার পরও অনড় অবস্থানে শিক্ষার্থীরা

আর রাকসু নির্বাচনে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ভোটার করার দাবিতে ছাত্রদলের আন্দোলন ঘিরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

দেশের বর্তমান অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো অশান্ত হয়ে যাওয়ার বিষয়কে একেবারেই বিচ্ছিন্ন মনে করছেন না বিশ্লেষকরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হতে পারে।

বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “গণঅভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাসগুলোর অস্থিতিশীলতার প্রভাব আগে যেভাবে জাতীয় রাজনীতিতে পড়তো, এখন তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পড়বে”।

আগের দিন স্থানীয় গ্রাম বাসীর সাথে সংঘর্ষের পর সোমবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকা ১৪৪ ধারা বলবৎ রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরএকজন সাংবাদিক বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, সোমবার সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাগোয়া জোবরা গ্রাম ও ক্যাম্পাসের আশপাশে যৌথ বাহিনীক টহল দিতে দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এবং একই সাথে রোববারের সংঘর্ষের ঘটনায় মামলার প্রস্তুতিও নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এসব ঘটনা ঘিরে ওই ক্যাম্পাসে এখনো এক ধরনের থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ক্লাস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি।

গেলো সপ্তাহে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দুইদিন পরেই গত শনিবার রাতে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় গ্রামবাসীর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।

স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে শনিবার রাতে এক শিক্ষার্থী ও স্থানীয় এক বাড়ির দারোয়ানের বাদানুবাদকে ঘিরে।

শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, শনিবার রাতে ঘটনাকে ঘিরে এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসু নির্বাচনকে একটি কারণ হিসেবে দেখছেন তারা।

এর ব্যাখ্যায় শিক্ষার্থীদের দাবি, ওই ঘটনাটিকে পুঁজি করে শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ অতি উৎসাহী আচরণ করেছে শিক্ষার্থীদের পক্ষ নিয়ে। যাদের কেউ কেউ চাকসু নির্বাচনে প্রার্থীও হতে চাচ্ছেন। যে কারণে ঘটনাটি আরো জটিল আকার ধারণ করে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা রাকসু নির্বাচনে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে কোষাধ্যক্ষের কার্যালয়ে রোববার তালা ঝুলিয়ে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

একই দাবিতে সোমবারও বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল। এই ঘটনাটিকে ঘিরে এখনো এক ধরনের অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে সেখানে।

অন্যদিকে, তিন দফা দাবিতে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও সংঘর্ষ ও অস্থিরতার ঘটনা ঘটে রোববার। এরপর অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশও দেওয়া হয়।

কিন্তু সেই দাবি উপেক্ষা করে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তারা হলেই অবস্থান করছে। একই সাথে নতুন করে ছয় দফা দাবি জানিয়েছে প্রশাসনের কাছে।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আব্দুল আলীম বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি শান্তিপূর্ণভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। এখন যদি শিক্ষার্থীরা হল ত্যাগ করে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাস খুলে দিয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলবে”।

বিবিসি বাংলার হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করতে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

শিক্ষা কার্যক্রমে সংকট বাড়বে?
গত বছর কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকে শেখ হাসিনার শাসনের পতনের এক দফা আন্দোলন এবং পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখে ওই শাসনের পতনের পরও অনেক ক্যাম্পাসে এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি শিক্ষা কার্যক্রম।

বরং দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একের পর এক অস্থিরতা দেখা যায়। কোথাও উপাচার্য অপসারণ, কোথাও নাম পরিবর্তনের দাবি, আবার কোথাও আবাসন-সংকটের মতো বিষয় নিয়ে আন্দোলন হয়েছে গতএক বছরে।

এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম, তৈরি হচ্ছে প্রশাসনিক জটিলতাও। শঙ্কা দেখা দিচ্ছে সেশনজটসহ বিভিন্ন সংকটের।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনিতে গত বছরের জুলাই অগাস্টের আন্দোলন ঘিরে টানা দুই তিন মাস ক্যাম্পাসগুলোয় শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্নভাবে ব্যহত হয়। এরপর একের পর এক অস্থিরতা ও আন্দোলনে সংকট আরো বাড়ছে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক সাহাবুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এমনিতেই আমরা দেখেছি চব্বিশের আন্দোলন ও তার পরবর্তীতে ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম অনেকদিন ধরে বন্ধ ছিল। এখন নতুন করে আবার আন্দোলনে দুই ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, পরীক্ষাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে”।

তিনি মনে করছেন, এই আন্দোলনের ফলে একাডেমিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। এর ফলে দীর্ঘ সেশনজট তৈরি হতে পারে।

বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খানের মতে, ছোট ছোট বিক্ষোভ থেকে যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে ক্যাম্পাসগুলোয়, তার নেতিবাচক প্রভাব শুধু সেই ক্যাম্পাস নয়, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এর ফলে একটা দীর্ঘমেয়াদি সংকটের আশঙ্কার কথাই গুরুত্ব দিয়ে বলছেন বিশ্লেষকরা।

রাজনীতিতে কি প্রভাব পড়তে পারে?
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তখন কুয়েটের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে সরিয়ে দেয় সরকার। ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বেশ কিছুদিন সরগরম ছিল জাতীয় রাজনীতি।

আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনীতিতে নানা আলোচনা চলছে। একই সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিভেদও তৈরি হয়েছে, প্রায় একই সময়ে ক্যাম্পাসগুলোয় টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

যে কারণে জাতীয় নির্বাচনের আগে এই বিষয়গুলোকে একেবারে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা মনে করছেন না বিশ্লেষকরা।

তারা যুক্তি দিয়ে বলছেন যে, প্রাথমিকভাবে দেখলে মনে হবে ঘটনাগুলোর সাথে রাজনীতির প্রভাব নাই। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে সব কিছুর পেছনেই কোনো না কোনোভাবে রাজনীতি জড়িত।

অধ্যাপক সাহাবুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ডাকসু- রাকসু বা চাকসু নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা আছে। এখানে পুরো বিষয়গুলোও কাজ করছে। বিষয়গুলো আলাদাভাবে দেখার কোন সুযোগ নাই। বিচ্ছিন্ন ভাবার কোন কারণ নাই”।

এবং এই সংকট যদি শিগগিরই দূর করা না যায় তাহলে ক্যাম্পাস রাজনীতির প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে খুব বড় আকারে পড়ার আশঙ্কার কথাও তিনি বলছিলেন।

ক্যাম্পাসের অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশের প্রভাব কেন জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে, এর একটা ব্যাখ্যা মিলেছে বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খানের কথায়।

মিজ খান মনে করেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। যে কারণে ছাত্রদের ক্ষমতা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। যে কারণে ছাত্ররাই প্রভাবিত করতে পারে রাজনীতিকে।

রাশেদা রওনক খান বলছিলেন, “এর প্রভাব আগে যেভাবে রাজনীতিতে পড়তো, তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি পড়বে। কারণ এই মুহূর্তে জাতীয় রাজনীতির বীজটা ছাত্র রাজনীতি বা ছাত্রদের মুভমেন্ট থেকে আসা। ফলে এই প্রভাবটা প্রচন্ডভাবে জাতীয় রাজনীতিতে পড়বে। যার ফলাফল খুব ভাল কিছু হবে না”।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সর্বাধিক পঠিত

হঠাৎই শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা, এর কী প্রভাব পড়তে পারে দেশের রাজনীতিতে?

প্রকাশিত সময় : ১১:৩০:২৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

চলতি সপ্তাহে ঢাকায় দুইটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষ ঘিরে রাজনীতিতে অস্থিরতার মধ্যে হঠাৎই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের শিক্ষাঙ্গন। আলাদা আলাদা ইস্যুকে কেন্দ্র করে রোববার তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা ও সংঘর্ষের পর দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে।

এসব ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ কেন বা কি কারণে এমন অশান্ত হয়ে উঠলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো।

দেশের রাজনীতিতে নানা ইস্যুতে অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে ক্যাম্পাসগুলোও অশান্ত হয়ে ওঠার বিষয়গুলো নিয়ে নানা আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

বিশেষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় গ্রামবাসীর সংঘর্ষের পর ক্যাম্পাসে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় এখনো ১৪৪ ধারা বলবৎ রয়েছে।

এদিকে, তিন দফা দাবিতে ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও সংঘর্ষের জের ধরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা ও আবাসিক হল খালি করার ঘোষণার পরও অনড় অবস্থানে শিক্ষার্থীরা

আর রাকসু নির্বাচনে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের ভোটার করার দাবিতে ছাত্রদলের আন্দোলন ঘিরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

দেশের বর্তমান অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো অশান্ত হয়ে যাওয়ার বিষয়কে একেবারেই বিচ্ছিন্ন মনে করছেন না বিশ্লেষকরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হতে পারে।

বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “গণঅভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাসগুলোর অস্থিতিশীলতার প্রভাব আগে যেভাবে জাতীয় রাজনীতিতে পড়তো, এখন তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পড়বে”।

আগের দিন স্থানীয় গ্রাম বাসীর সাথে সংঘর্ষের পর সোমবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকা ১৪৪ ধারা বলবৎ রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরএকজন সাংবাদিক বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, সোমবার সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাগোয়া জোবরা গ্রাম ও ক্যাম্পাসের আশপাশে যৌথ বাহিনীক টহল দিতে দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এবং একই সাথে রোববারের সংঘর্ষের ঘটনায় মামলার প্রস্তুতিও নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এসব ঘটনা ঘিরে ওই ক্যাম্পাসে এখনো এক ধরনের থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ক্লাস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি।

গেলো সপ্তাহে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দুইদিন পরেই গত শনিবার রাতে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় গ্রামবাসীর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।

স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে শনিবার রাতে এক শিক্ষার্থী ও স্থানীয় এক বাড়ির দারোয়ানের বাদানুবাদকে ঘিরে।

শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, শনিবার রাতে ঘটনাকে ঘিরে এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসু নির্বাচনকে একটি কারণ হিসেবে দেখছেন তারা।

এর ব্যাখ্যায় শিক্ষার্থীদের দাবি, ওই ঘটনাটিকে পুঁজি করে শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ অতি উৎসাহী আচরণ করেছে শিক্ষার্থীদের পক্ষ নিয়ে। যাদের কেউ কেউ চাকসু নির্বাচনে প্রার্থীও হতে চাচ্ছেন। যে কারণে ঘটনাটি আরো জটিল আকার ধারণ করে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা রাকসু নির্বাচনে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার দাবিতে কোষাধ্যক্ষের কার্যালয়ে রোববার তালা ঝুলিয়ে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

একই দাবিতে সোমবারও বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল। এই ঘটনাটিকে ঘিরে এখনো এক ধরনের অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে সেখানে।

অন্যদিকে, তিন দফা দাবিতে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও সংঘর্ষ ও অস্থিরতার ঘটনা ঘটে রোববার। এরপর অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশও দেওয়া হয়।

কিন্তু সেই দাবি উপেক্ষা করে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তারা হলেই অবস্থান করছে। একই সাথে নতুন করে ছয় দফা দাবি জানিয়েছে প্রশাসনের কাছে।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আব্দুল আলীম বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি শান্তিপূর্ণভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে। এখন যদি শিক্ষার্থীরা হল ত্যাগ করে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাস খুলে দিয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলবে”।

বিবিসি বাংলার হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল ফলো করতে এখানে ক্লিক/ট্যাপ করুন

শিক্ষা কার্যক্রমে সংকট বাড়বে?
গত বছর কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকে শেখ হাসিনার শাসনের পতনের এক দফা আন্দোলন এবং পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখে ওই শাসনের পতনের পরও অনেক ক্যাম্পাসে এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি শিক্ষা কার্যক্রম।

বরং দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একের পর এক অস্থিরতা দেখা যায়। কোথাও উপাচার্য অপসারণ, কোথাও নাম পরিবর্তনের দাবি, আবার কোথাও আবাসন-সংকটের মতো বিষয় নিয়ে আন্দোলন হয়েছে গতএক বছরে।

এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম, তৈরি হচ্ছে প্রশাসনিক জটিলতাও। শঙ্কা দেখা দিচ্ছে সেশনজটসহ বিভিন্ন সংকটের।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনিতে গত বছরের জুলাই অগাস্টের আন্দোলন ঘিরে টানা দুই তিন মাস ক্যাম্পাসগুলোয় শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্নভাবে ব্যহত হয়। এরপর একের পর এক অস্থিরতা ও আন্দোলনে সংকট আরো বাড়ছে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক সাহাবুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এমনিতেই আমরা দেখেছি চব্বিশের আন্দোলন ও তার পরবর্তীতে ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম অনেকদিন ধরে বন্ধ ছিল। এখন নতুন করে আবার আন্দোলনে দুই ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, পরীক্ষাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে”।

তিনি মনে করছেন, এই আন্দোলনের ফলে একাডেমিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। এর ফলে দীর্ঘ সেশনজট তৈরি হতে পারে।

বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খানের মতে, ছোট ছোট বিক্ষোভ থেকে যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে ক্যাম্পাসগুলোয়, তার নেতিবাচক প্রভাব শুধু সেই ক্যাম্পাস নয়, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এর ফলে একটা দীর্ঘমেয়াদি সংকটের আশঙ্কার কথাই গুরুত্ব দিয়ে বলছেন বিশ্লেষকরা।

রাজনীতিতে কি প্রভাব পড়তে পারে?
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তখন কুয়েটের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে সরিয়ে দেয় সরকার। ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বেশ কিছুদিন সরগরম ছিল জাতীয় রাজনীতি।

আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনীতিতে নানা আলোচনা চলছে। একই সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিভেদও তৈরি হয়েছে, প্রায় একই সময়ে ক্যাম্পাসগুলোয় টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

যে কারণে জাতীয় নির্বাচনের আগে এই বিষয়গুলোকে একেবারে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা মনে করছেন না বিশ্লেষকরা।

তারা যুক্তি দিয়ে বলছেন যে, প্রাথমিকভাবে দেখলে মনে হবে ঘটনাগুলোর সাথে রাজনীতির প্রভাব নাই। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে সব কিছুর পেছনেই কোনো না কোনোভাবে রাজনীতি জড়িত।

অধ্যাপক সাহাবুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ডাকসু- রাকসু বা চাকসু নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা আছে। এখানে পুরো বিষয়গুলোও কাজ করছে। বিষয়গুলো আলাদাভাবে দেখার কোন সুযোগ নাই। বিচ্ছিন্ন ভাবার কোন কারণ নাই”।

এবং এই সংকট যদি শিগগিরই দূর করা না যায় তাহলে ক্যাম্পাস রাজনীতির প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে খুব বড় আকারে পড়ার আশঙ্কার কথাও তিনি বলছিলেন।

ক্যাম্পাসের অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশের প্রভাব কেন জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে, এর একটা ব্যাখ্যা মিলেছে বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খানের কথায়।

মিজ খান মনে করেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। যে কারণে ছাত্রদের ক্ষমতা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। যে কারণে ছাত্ররাই প্রভাবিত করতে পারে রাজনীতিকে।

রাশেদা রওনক খান বলছিলেন, “এর প্রভাব আগে যেভাবে রাজনীতিতে পড়তো, তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি পড়বে। কারণ এই মুহূর্তে জাতীয় রাজনীতির বীজটা ছাত্র রাজনীতি বা ছাত্রদের মুভমেন্ট থেকে আসা। ফলে এই প্রভাবটা প্রচন্ডভাবে জাতীয় রাজনীতিতে পড়বে। যার ফলাফল খুব ভাল কিছু হবে না”।

সূত্র: বিবিসি বাংলা