শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সামাজিক ব্যবসা, যুবশক্তি ও প্রযুক্তিই টেকসই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সদর দপ্তরে স্থানীয় সময় সোমবার অনুষ্ঠিত ‘সোশাল বিজনেস, ইয়ুথ অ্যান্ড টেকনোলজি’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের পার্শ্ব-সেশনে সামাজিক ব্যবসা, যুবশক্তি ও প্রযুক্তিকে টেকসই ভবিষ্যতের মূল চাবিকাঠি হিসেবে তুলে ধরেছেন।

উপস্থিত অতিথিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন একটি বিশ্ব গড়ে তুলতে চাই যেখানে প্রত্যেক মানুষের জন্য সুযোগ, মর্যাদা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। ব্যবসা শুধু মুনাফার জন্য নয়, মানুষের কল্যাণ, পরিবেশ সুরক্ষা এবং সমাজের সমৃদ্ধির জন্য কাজ করবে।’

ড. ইউনূস বলেন, ‘বর্তমান বিশ্ব এক সংকটময় সময়ে দাঁড়িয়ে-জলবায়ু পরিবর্তনের দাবানল, বৈষম্য বৃদ্ধির গভীর চিহ্ন, সংঘাত ও শরণার্থী সংকট মানবতার পরীক্ষা নিচ্ছে। এসব সংকট পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত, তাই পুরনো সমাধান আর যথেষ্ট নয়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন একটি অর্থনীতির দিকে এগোতে হবে যা মানুষের কল্যাণ, সামাজিক ন্যায়-বিচার এবং পরিবেশ সংরক্ষণকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেবে। এই তীব্র চ্যালেঞ্জের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া।’

জাতিসংঘের বাজেট কমানো বা আন্তর্জাতিক সহায়তা কমানো দেশের জন্য প্রতিকূল প্রভাব ফেলবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়ানো এবং ন্যায়সঙ্গত উত্তরণের পথ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’

তিনি যোগ করে বলেন, ‘নতুন বিশ্ব গড়ার পথ আজকের সাহসী পদক্ষেপ, প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার এবং যুবশক্তির উদ্ভাবনী ক্ষমতায় নিহিত। তরুণরা নতুন ধারণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তন আনতে পারে।’

ড. ইউনূস সামাজিক ব্যবসার শক্তিকেও উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘এক ডলারের ঋণ থেকে শুরু হলেও আজ সামাজিক ব্যবসা স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈশ্বিক পরিবর্তন আনছে। এটি প্রমাণ করে যে ব্যবসা অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি মানুষের কল্যাণেও কাজ করতে পারে।’

তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের কল্পনা এবং উদ্ভাবনের শক্তি সমাজে স্থায়ী সমাধান আনতে পারে। কেবল কল্পনা নয়, কাজও শুরু করতে হবে-আজই।’

প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডেটা ও অন্যান্য উদ্ভাবনী প্রযুক্তি আমাদের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে, যদি তা নৈতিকভাবে ও মানবকল্যাণে কাজে লাগানো হয়। প্রযুক্তিকে কল্যাণমূলক উদ্যোগের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে, যাতে সকলের জন্য টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।’

ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘শূন্য কার্বন নিঃসরণ, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ এবং শূন্য বেকারত্ব-এই তিন লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে আমরা নতুন প্রজন্মকে সমাজে নেতৃত্ব দিতে চাই। তরুণরা থ্রি-জিরো ক্লাব গড়ে সমাজে স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে।’

তিনি সব শেষ বলেন, ‘সামাজিক ব্যবসা, যুবশক্তি এবং প্রযুক্তিকে একত্রিত করে আমরা একটি নতুন যুগের বিশ্ব গড়ে তুলতে পারি-যেখানে ন্যায়, টেকসই উন্নয়ন এবং আশা থাকবে।’

এর আগে স্থানীয় সময় বিকেল ৩টায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পৌঁছেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তার সফর সঙ্গী হিসেবে রয়েছেন অন্তবর্তী সরকারের ৬ উপদেষ্টাসহ বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা।

সূচি অনুযায়ী অধ্যাপক ইউনূস আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেবেন।

২৭ তারিখ অভিবাসীদের সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন এবং অধিবেশনের সাইড লাইনে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্থনিও গুতেরেজ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফসহ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করবেন সরকার প্রধান। দেখা হবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সর্বাধিক পঠিত

সামাজিক ব্যবসা, যুবশক্তি ও প্রযুক্তিই টেকসই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি

প্রকাশিত সময় : ০৫:৪২:২০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সদর দপ্তরে স্থানীয় সময় সোমবার অনুষ্ঠিত ‘সোশাল বিজনেস, ইয়ুথ অ্যান্ড টেকনোলজি’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের পার্শ্ব-সেশনে সামাজিক ব্যবসা, যুবশক্তি ও প্রযুক্তিকে টেকসই ভবিষ্যতের মূল চাবিকাঠি হিসেবে তুলে ধরেছেন।

উপস্থিত অতিথিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমরা এমন একটি বিশ্ব গড়ে তুলতে চাই যেখানে প্রত্যেক মানুষের জন্য সুযোগ, মর্যাদা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। ব্যবসা শুধু মুনাফার জন্য নয়, মানুষের কল্যাণ, পরিবেশ সুরক্ষা এবং সমাজের সমৃদ্ধির জন্য কাজ করবে।’

ড. ইউনূস বলেন, ‘বর্তমান বিশ্ব এক সংকটময় সময়ে দাঁড়িয়ে-জলবায়ু পরিবর্তনের দাবানল, বৈষম্য বৃদ্ধির গভীর চিহ্ন, সংঘাত ও শরণার্থী সংকট মানবতার পরীক্ষা নিচ্ছে। এসব সংকট পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত, তাই পুরনো সমাধান আর যথেষ্ট নয়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন একটি অর্থনীতির দিকে এগোতে হবে যা মানুষের কল্যাণ, সামাজিক ন্যায়-বিচার এবং পরিবেশ সংরক্ষণকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেবে। এই তীব্র চ্যালেঞ্জের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া।’

জাতিসংঘের বাজেট কমানো বা আন্তর্জাতিক সহায়তা কমানো দেশের জন্য প্রতিকূল প্রভাব ফেলবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়ানো এবং ন্যায়সঙ্গত উত্তরণের পথ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’

তিনি যোগ করে বলেন, ‘নতুন বিশ্ব গড়ার পথ আজকের সাহসী পদক্ষেপ, প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার এবং যুবশক্তির উদ্ভাবনী ক্ষমতায় নিহিত। তরুণরা নতুন ধারণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তন আনতে পারে।’

ড. ইউনূস সামাজিক ব্যবসার শক্তিকেও উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘এক ডলারের ঋণ থেকে শুরু হলেও আজ সামাজিক ব্যবসা স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈশ্বিক পরিবর্তন আনছে। এটি প্রমাণ করে যে ব্যবসা অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি মানুষের কল্যাণেও কাজ করতে পারে।’

তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের কল্পনা এবং উদ্ভাবনের শক্তি সমাজে স্থায়ী সমাধান আনতে পারে। কেবল কল্পনা নয়, কাজও শুরু করতে হবে-আজই।’

প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডেটা ও অন্যান্য উদ্ভাবনী প্রযুক্তি আমাদের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করতে পারে, যদি তা নৈতিকভাবে ও মানবকল্যাণে কাজে লাগানো হয়। প্রযুক্তিকে কল্যাণমূলক উদ্যোগের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে, যাতে সকলের জন্য টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।’

ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘শূন্য কার্বন নিঃসরণ, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ এবং শূন্য বেকারত্ব-এই তিন লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে আমরা নতুন প্রজন্মকে সমাজে নেতৃত্ব দিতে চাই। তরুণরা থ্রি-জিরো ক্লাব গড়ে সমাজে স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে।’

তিনি সব শেষ বলেন, ‘সামাজিক ব্যবসা, যুবশক্তি এবং প্রযুক্তিকে একত্রিত করে আমরা একটি নতুন যুগের বিশ্ব গড়ে তুলতে পারি-যেখানে ন্যায়, টেকসই উন্নয়ন এবং আশা থাকবে।’

এর আগে স্থানীয় সময় বিকেল ৩টায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পৌঁছেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তার সফর সঙ্গী হিসেবে রয়েছেন অন্তবর্তী সরকারের ৬ উপদেষ্টাসহ বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতারা।

সূচি অনুযায়ী অধ্যাপক ইউনূস আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেবেন।

২৭ তারিখ অভিবাসীদের সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন এবং অধিবেশনের সাইড লাইনে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্থনিও গুতেরেজ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফসহ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করবেন সরকার প্রধান। দেখা হবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও।