ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার বেশকিছু দিন বাকি থাকলেও বরিশালের রাজনীতিতে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। জেলার ছয়টি আসনেই বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে এবং মাঠে তাদের তৎপরতা দৃশ্যমান। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না থাকায় প্রতিটি আসনে এই তিন দলের প্রার্থীদের মধ্যে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া গেছে। তবে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা আটটি দল যুগপৎ আন্দোলনে থাকায় তাদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত আসন সমঝোতা হওয়ার কথা রয়েছে। এতে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন থেকে যে কোনো একজন প্রার্থী হতে পারেন। সেক্ষেত্রে বিএনপির প্রার্থী ও সমমনা ৮ দলের মনোনীত প্রার্থীর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যাবে। এ ছাড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচনী প্রস্তুতির কথা বললেও এখন পর্যন্ত তাদের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। বাম দলগুলোর প্রার্থীরাও এখনও মাঠে নামেননি।
বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট আবুল কালাম শাহীন বলেন, বরিশাল অঞ্চল বিএনপি-অধ্যুষিত। ছয়টি আসনেই বিগত নির্বাচনগুলোতে দলের যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন; প্রত্যেকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আগামী নির্বাচনে যাদের মনোনীত করেছেন, তারাও বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন; ইনশাআল্লাহ।
বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) : বরিশালের প্রবেশদ্বার এই আসনে বিএনপির প্রার্থী হয়েছেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী জহির উদ্দিন স্বপন। গত ৭ নভেম্বর তিনি বড় শোডাউন করে প্রচার কার্যক্রম শুরু করেন। জামায়াত প্রার্থী মাওলানা কামরুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনের রাসেল সরদার মেহেদী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আগৈলঝাড়া উপজেলা আকহ্বায়ক মাজহারুল ইসলাম নিপু গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ আসনে বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর বহুধারায় বিভক্ত বিএনপি এখন স্বপনকে ঘিরে একইধারায় মিলিত হয়েছে। এ বিষয়ে জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, দেশের তরুণ ভোটাররা এবার পরিবর্তনের প্রত্যাশায় উন্মুখ। অন্তর্বর্তী সরকার একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে বলে তাঁরা আশাবাদী এবং সেই ভোটে বিএনপি জয়ী হবে।
বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) : তৃতীয়বারের মতো এ আসনে বিএনপি থেকে প্রার্থী করা হয়েছে এস সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টুকে। জামায়াতের প্রার্থী আবদুল মান্নান ও ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা নেছার উদ্দীন এলাকায় প্রচারে সক্রিয়। এ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভির সম্ভাব্য প্রার্থিতা নিয়েও রাজনৈতিক মাঠে ব্যাপক গুঞ্জন রয়েছে।
বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) : বরিশালের গুরুত্বপূর্ণ এ আসনে অবশেষে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। প্রথম দফায় ঘোষিত প্রার্থী তালিকায় না রাখায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা মাঠে ছিল মুখোমুখি। প্রথম দফার ঘোষণার এক মাস পর বৃহস্পতিবার বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীনকে প্রার্থী ঘোষণা করায় স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান সমর্থকরা হতাশ। তবে সেলিমা রহমানের সমর্থক বিএনপি নেতা ছত্তার খানের এ আসনে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দি¦তা করার সম্ভাবনা রয়েছে।
জানা যায়, ২০০৮ সালে এ আসনে সেলিমা রহমান বিএনপি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। মনোনয়ন না পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রায় ২০ হাজার ভোট পান জয়নুল আবেদীন। ওই নির্বাচনে মাত্র পাঁচ হাজার ভোটের ব্যবধানে জাপা প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া টিপুর কাছে পরাজিত হন সেলিমা রহমান। সেই থেকেই দুই উপজেলায় সেলিমা ও জয়নুল সমর্থক নেতাকর্মীরা মুখোমুখি।
আসনটির বাবুগঞ্জ উপজেলার চেয়ে ম্লুাদী উপজেলায় ভোটার সংখ্যা বেশি। আর মুলাদীর বাসিন্দা জয়নুল আবেদীন ও বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও মুলাদী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান এবং পৌর মেয়র আ. ছত্তার খান। মুলাদীতে ছত্তার খানের শক্ত অবস্থান এবং জনপ্রিয় হওয়ায় আগামী নির্বাচনে ছত্তার খানকে নিয়ে অনেক হিসেব কষতে শুরু করেছে ভোটাররা।
সেলিমা রহমান সমর্থক ছত্তার খান নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে ভোটের হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে পারে। আ. ছত্তার খান বলেন, জনগণকে যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেটা সমর্থন করব।
অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, আসনটি বিএনপি-অধ্যুষিত। সকল ভেদাভেদ ভুলে ধানের শীষকে বিজয়ী করতে জনগণের সঙ্গে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা কাজ করছে।
অন্যদিকে এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন বরিশাল মহানগর আমির অধ্যক্ষ জহিরউদ্দিন মু. বাবর এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের বরিশাল জেল সভাপতি উপাধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজুল ইসলাম। ইসলামী ও সমমনা ৮ দলের সমঝোতা হলে তাদের দুজনের মধ্যে যে কোনো একজন প্রার্থী হবেন বলে জানা গেছে। এই আসনে আরও প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদের।
বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ) : মেঘনা-তেঁতুলিয়া ও কালাবদর নদী ঘেরা এই আসনে বিএনপির প্রার্থী হয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান। জামায়াতের প্রার্থী জেলা আমির অধ্যাপক মাওলানা আবদুর জব্বার ও ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী চরমোনাই পীরের ছোট ভাই মুফতি সৈয়দ এছহাক মুহাম্মদ আবুল খায়ের এবং এনসিপির বরিশাল জেলার প্রধান সমন্বয়কারী আবু সাইদ মুসা। তারা প্রত্যেকেই নিয়মিত সভা-সমাবেশ ও সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।
২০০৮ সালে বিজয়ী এই আসনের বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মেজবাউদ্দিন ফরহাদ মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার আসনটির দুই উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ নির্বাচনী মাঠে অনুপস্থিত। ফলে বিএনপি প্রার্থী ফরহাদ সমর্থকদের মাঠে নামাতে ব্যর্থ হলে ভোটের ফলাফল ইসলামীপন্থি প্রার্থীর ঘরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বরিশাল-৫ (সদর) : আসনে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এ আসনে প্রার্থী হয়েছেন পাঁচবারের সাবেক সংসদ সদস্য মজিবর রহমান সরোয়ার। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুফতি মুহাম্মদ ফয়জুল করীম এবং জামায়াতের প্রার্থী মুয়াযযম হোসাইন হেলালও সক্রিয়ভাবে প্রচারে নেমেছেন।
দীর্ঘদিন দ্বিধাবিভক্ত বিএনপি গত ৩ নভেম্বর প্রার্থী ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে বরিশাল বিএনপি এখন একই ধারায় মিলিত হয়েছে। সরোয়ারকে ঘিরে বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াত নির্বাচনে জোটবদ্ধ হলে এ আসনে প্রার্থী হতে পারেন ইসলামী আন্দোলনের মুফতি মুহাম্মদ ফয়জুল করীম। বিএনপির ঘাঁটিতে তারা নির্বাচিত হতে সর্বশক্তি ব্যয় করবেন বলে জানান ফয়জুল করীম। তিনি বলেন, পুরনো নির্বাচনের হিসাব দিয়ে আগামী নির্বাচনের হিসাব মেলানো যাবে না। দেশের মানুষ আর পুরনো বন্দোবস্ত চায় না। বিএনপির প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, ঐতিহাসিকভাবে বরিশাল বিএনপির ঘাঁটি, এটা সবাই জানেন। তা ছাড়া এখানে জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন, আস্থা আগের চেয়ে আরও অনেক বেড়েছে। তাই আগামী নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী শক্তি অভূতপূর্ব সমর্থন পাবে।
বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) : এখানে বিএনপির প্রার্থী দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম, আর জামায়াতের প্রার্থী জেলা সেক্রেটারি মাওলানা মাহমুদুন্নবী। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির নেতা এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারও প্রার্থী হতে পারেন বলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান।

রিপোর্টারের নাম 

























