বিশ্ব অর্থনীতিতে এ বছরের শেষটা মনে রাখার মতো। চলতি ডিসেম্বরে ফোর্বস ম্যাগাজিন যখন তাদের রিয়েল-টাইম বিলিয়নিয়ার বা বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের হালনাগাদ তালিকা প্রকাশ করল, তখন ওয়াল স্ট্রিট থেকে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ- সবখানেই বিস্ময়ের ঢেউ খেলে গেল। বিশ্ব অর্থনীতি এখন এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে যখন সাধারণ মানুষ মুদ্রাস্ফীতি আর জীবনযাপনের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে, অন্যদিকে গুটিকয়েক মানুষের হাতে জমছে কল্পনাতীত সম্পদ। ২০২৫ সালটি ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বা এআই বিপ্লবের বছর হিসেবে। আর এই বিপ্লবই ওলটপালট করে দিয়েছে বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের দীর্ঘদিনের চেনা মানচিত্র। শীর্ষ ১০ ধনীর এই তালিকায় এবার ঘটে গেছে এক নীরব কিন্তু নাটকীয় বিপ্লব। দীর্ঘদিনের চেনা সমীকরণ ভেঙে গুগলের রহস্যময় সহ-প্রতিষ্ঠাতা, প্রচারবিমুখ ল্যারি পেইজ উঠে এসেছেন দ্বিতীয় স্থানে। অন্যদিকে, যে নামটিকে আমরা গত তিন দশক ধরে ‘বিশ্বের শীর্ষ ধনী’র সমার্থক হিসেবে জানতাম- সেই বিল গেটস আজ আর সেরা দশেও নেই। ইলন মাস্কের একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় থাকলেও পেছনের সারিতে ঘটে যাওয়া এই রদবদল অর্থনীতিবিদদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। ফোর্বসের তালিকা নিয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছেন শামস বিশ্বাস
শীর্ষে ইলন মাস্ক ট্রিলিয়নের পথে সম্পদ
তালিকার দিকে তাকালে প্রথমেই যাকে দেখা যায়, তিনি যেন বাকিদের ধরাছোঁয়ার বাইরে এক অন্য গ্রহের বাসিন্দা। ৫৪ বছর বয়সী ইলন মাস্ক। টেকনোলজি বিশ্বের এই ‘ব্যাড বয়’ বা খামখেয়ালি জিনিয়াস এখন ৪৮৩ বিলিয়ন ডলারের মালিক। তালিকার দ্বিতীয় স্থানে থাকা ল্যারি পেইজের চেয়ে তিনি প্রায় ২২১ বিলিয়ন ডলার এগিয়ে! এই ব্যবধানটি এতটাই বিশাল যে, নিকট ভবিষ্যতে কেউ তাকে ছোঁবে, এমন সম্ভাবনা তো নেই-ই, বরং তিনি যেন একাই ট্রিলিয়ন ডলারের পথে হাঁটছেন। ভাবা যায়? ৪৮৩ বিলিয়ন ডলার! যেখানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনী ২৬০ বিলিয়নির ঘরে সংগ্রাম করছেন, সেখানে মাস্ক প্রায় ৫০০ বিলিয়নির দোরগোড়ায়। মে ২০২৪ সাল থেকেই তিনি বিশ্বের শীর্ষ ধনীর মুকুটটি শক্ত করে ধরে রেখেছেন। সাম্প্রতিক হিসাবে তার সম্পদ ১৫ বিলিয়ন ডলার কমলেও, তার শীর্ষস্থান ‘আনটাচেবল’ বা স্পর্শাতীতই রয়ে গেছে।
মাস্ক সম্পদের তিন স্তম্ভ
টেসলা (Tesla) : বৈদ্যুতিক গাড়ির দুনিয়ায় রাজত্ব করা এই কোম্পানিটি তার সম্পদের মূল ভিত্তি। যদিও গাড়ির বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে এবং বিক্রি ওঠানামা করছে, কিন্তু বিনিয়োগকারীরা টেসলাকে নিছক একটি গাড়ি কোম্পানির চেয়ে ‘ফিউচার টেকনোলজি’ কোম্পানি হিসেবেই বেশি মূল্যায়ন করেন। ফলে এর শেয়ার ভ্যালু এখনও আকাশচুম্বী।
স্পেসএক্স (SpaceX) : মহাকাশ ভ্রমণ ও রকেট সায়েন্সে এই প্রাইভেট কোম্পানিটি এখন নাসার চেয়েও বেশি শক্তিশালী ও কার্যকর। বিশেষ করে ‘স্টারলিংক’ প্রজেক্টের মাধ্যমে তিনি মহাকাশ থেকে বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেট সেবা বিক্রি করছেন, যা তার আয়ের এক বিশাল ‘টাকার খনি’ বা মানি মেশিন হিসেবে কাজ করছে।
এক্সএআই (xAI) : মাস্কের নতুন বাজি। চ্যাটজিপিটি বা গুগলের এআই-এর সঙ্গে পাল্লা দিতে তিনি তৈরি করেছেন নিজস্ব এই এআই কোম্পানি। খুব অল্প সময়েই বিনিয়োগকারীদের কাছে এটি ‘হট ফেভারিট’ হয়ে উঠেছে এবং এর মূল্যায়ন এখন তুঙ্গে। মাস্কের এই বিপুল সম্পদ কেবল সংখ্যার খেলা নয়, এটি তার অসীম ক্ষমতা ও প্রভাবের প্রতীক। তিনি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি, যার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) দেওয়া একটিমাত্র পোস্ট বা টুইট শেয়ার বাজারে ধস নামাতে পারে, বিটকয়েনের দাম অর্ধেক করে দিতে পারে, আবার কোনো মিম কয়েনকে চাঁদে পৌঁছে দিতে পারে। মহাকাশ থেকে এআই- ভবিষ্যতের সব চাবিকাঠিই এখন এই ‘বাস্তব জীবনের টনি স্টার্ক’ বা আয়রন ম্যানের হাতের মুঠোয়।
তৃতীয়তে ল্যারি এলিসন
ওরাকলের অপ্রতিরোধ্য প্রত্যাবর্তন ল্যারি পেইজের নাটকীয় উত্থানের ফলে যিনি এক ধাপ নিচে নেমে গেছেন, তিনি হলেন সিলিকন ভ্যালির পোড় খাওয়া অশ্বারোহী ল্যারি এলিসন। ২৫৩ বিলিয়ন ডলার নিয়ে তিনি এখন তৃতীয় স্থানে। তবে এই অবনমন তার দুর্বলতা নয়, বরং গুগলের অবিশ্বাস্য গতির কাছে সাময়িক পরাজয় মাত্র। ৮১ বছর বয়সী এই প্রযুক্তিবিদ প্রমাণ করেছেন বয়স কেবল একটি সংখ্যা মাত্র। তার কোম্পানি ‘ওরাকল’ (Oracle) একসময় কেবল ডেটাবেস সফটওয়্যারের জন্য পরিচিত ছিল। কিন্তু এলিসন অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে কোম্পানিকে ক্লাউড কম্পিউটিং এবং এআই ইনফ্রাস্ট্রাকচারের দিকে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। বর্তমান বিশ্বে এআই মডেলগুলোকে প্রশিক্ষিত করার জন্য যে বিশাল ও শক্তিশালী ডেটা সেন্টার প্রয়োজন, তা সরবরাহে ওরাকল এখন অন্যতম ভরসার নাম। মাইক্রোসফট এবং ওপেনএআই-এর সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ এবং এআই অবকাঠামোতে তার একচ্ছত্র আধিপত্য এলিসনকে এখনও ২৫০ বিলিয়নির ওপরে শক্ত অবস্থানে রেখেছে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের লানাই দ্বীপের মালিক এই বিলাসী ধনকুবের প্রযুক্তি বিশ্বের ‘ওল্ড গার্ড’ হয়েও নতুনদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন সমানে সমান।
এক থেকে চারে জেফ বেজোস
ই-কমার্সের আড়ালে ক্লাউডের রাজা চতুর্থ স্থানে আছেন অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস (২৪৫ বিলিয়ন ডলার)। একসময় তিনি ছিলেন অবিসংবাদিতভাবে বিশ্বের এক নম্বর ধনী। এখন তিনি তালিকার চারে নেমে এলেও তার ক্ষমতার পরিধি কমেনি। সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ‘অনলাইন দোকানদার’ হিসেবে পরিচিত হলেও তার এই বিপুল সম্পদের আসল ইঞ্জিন এখন আর ই-কমার্স নয়। তার আয়ের মূল উৎস হলো ‘অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস’ (AWS)। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক ইন্টারনেট বা অ্যাপ চলে এই AWS-এর ওপর ভিত্তি করে। ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের এই একচ্ছত্র আধিপত্য বেজোসকে প্রতিনিয়ত আরও ধনী করছে। যদিও তিনি এখন অ্যামাজনের সিইও পদ ছেড়ে দিয়েছেন এবং ব্যস্ত আছেন তার প্রেমিকা লরেন সানচেজ, বিশাল প্রমোদতরি এবং মহাকাশ সংস্থা ‘ব্লু অরিজিন’ নিয়ে, তবুও অ্যামাজনের শেয়ারের লভ্যাংশ তার সিন্দুক ভরাতে ভুলছে না। ইলন মাস্কের সঙ্গে মহাকাশ জয়ের লড়াইয়ে তিনি কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও, ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে তিনি এখনও ক্ষুরধার।
পঞ্চম স্থানে গুগলের সের্গেই ব্রিন
গুগলের ‘মস্তিষ্ক’ এবং এআই বিপ্লব পঞ্চম স্থানে আছেন গুগলের আরেক সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ল্যারি পেইজের ছায়াসঙ্গী সের্গেই ব্রিন (২৪২ বিলিয়ন ডলার)। ল্যারি পেইজ যদি হন গুগলের ‘ভিশন’, তবে সের্গেই ব্রিন হলেন গুগলের ‘টেকনিক্যাল ব্রেন’। পেইজের মতোই তিনিও প্রচারবিমুখ, কিন্তু সিলিকন ভ্যালির ভেতরের খবর হলো- সাম্প্রতিক এআই যুদ্ধে গুগলকে এগিয়ে নিতে ব্রিন আবারও কোডিং ডেস্কে ফিরে এসেছেন।
২০২৫ সালে গুগলের এআই মডেল ‘জেমিনি’ যে সাফল্য দেখিয়েছে, তার বড় কৃতিত্ব ব্রিনের। দুই বন্ধু মিলে গুগলকে একটি ‘সার্চ ইঞ্জিন’ কোম্পানি থেকে পুরোদস্তুর ‘এআই-ফার্স্ট’ কোম্পানিতে রূপান্তর করেছেন। এই রূপান্তরের সুফল হিসেবেই আজ তিনি বিশ্বের পঞ্চম ধনী। তার অবস্থান প্রমাণ করে, প্রযুক্তির দুনিয়ায় পার্টনারশিপ বা বন্ধুত্ব কতটা শক্তিশালী হতে পারে।
ল্যারি পেইজের এআই ম্যাজিক
এবারের তালিকার সবচেয়ে বড় চমক ইলন মাস্ক নন, বরং গুগলের (অ্যালফাবেট) সহ-প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেইজ। ৫২ বছর বয়সী এই প্রযুক্তিবিদ বরাবরই প্রচারবিমুখ। স্টিভ জবস বা ইলন মাস্কের মতো তিনি কখনও মঞ্চ কাঁপিয়ে প্রোডাক্ট লঞ্চ করেন না, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তোলেন না। মিডিয়ার ক্যামেরা থেকে দূরে, নিভৃতে থাকতেই তিনি পছন্দ করেন। অথচ, এই আড়ালে থাকা মানুষটিই এবার করে ফেললেন অসাধ্য সাধন।
২৬২ বিলিয়ন ডলারের নেপথ্য গল্প ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হিসাব অনুযায়ী, ল্যারি পেইজের সম্পদ দাঁড়িয়েছে ২৬২ বিলিয়ন ডলার। জীবনে প্রথমবারের মতো তিনি উঠে এসেছেন বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনীর আসনে। মাত্র এক মাস আগেও তিনি ছিলেন তালিকার নিচের দিকে, কিন্তু নভেম্বরে মাত্র ৩০ দিনের ব্যবধানে তার সম্পদ বেড়েছে ৩০ বিলিয়ন ডলার! প্রশ্ন হলো, হঠাৎ এই জাদুর চাকা ঘুরল কীভাবে? বিশ্লেষকরা এক বাক্যে এর উত্তর দিচ্ছেন- ‘এআই বুম’ বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিস্ফোরণ। ২০২৪-২৫ সালে গুগল তাদের শক্তিশালী এআই মডেল ‘জেমিনি’ (Gemini) এবং অন্যান্য এআই টুলগুলো বাজারে এনে যে অভাবনীয় উন্নতি দেখিয়েছে, শেয়ারবাজার তাকে দুহাতে স্বাগত জানিয়েছে। গুগলের সার্চ ইঞ্জিন থেকে শুরু করে ক্লাউড কম্পিউটিং- সবখানেই এআই-এর সফল ইন্টিগ্রেশন বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করেছে। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, ভবিষ্যতের ইন্টারনেট হবে পুরোপুরি এআইনির্ভর এবং সেই ভবিষ্যতের চাবিকাঠিটি আছে গুগলের হাতেই। ফলে গুগলের প্যারেন্ট কোম্পানি ‘অ্যালফাবেট’-এর শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পেইজের পকেটে ঢুকেছে হাজার কোটি ডলার। ল্যারি পেইজ প্রমাণ করলেন, ব্যবসায় সফল হতে হলে সব সময় চিৎকার করে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে হয় না; বরং সঠিক সময়ে সঠিক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করাই আসল খেলা। নীরব কাজের মাধ্যমেই তিনি পেছনে ফেলেছেন ওরাকলের ল্যারি এলিসনকে, যিনি দীর্ঘদিন দ্বিতীয় স্থানটি আঁকড়ে ধরেছিলেন।
ষষ্ঠতে জাকারবার্গ নেপথ্যে মেটা
মেটাভার্সের খোলস ছেড়ে এআই-এর পথে তালিকায় মার্ক জাকারবার্গের অবস্থান (ষষ্ঠ) এবং সম্পদ (২৬৪ বিলিয়ন ডলার*) বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। সম্পদের অঙ্কে তিনি মাঝেমধ্যেই ল্যারি পেইজ বা এলিসনকে টপকে যান, কিন্তু মেটার (ফেসবুক) শেয়ারের উচ্চ অস্থিতিশীলতার কারণে তার র?্যাংকিং প্রতিনিয়ত ওঠানামা করে। কয়েক বছর আগে মেটাভার্স প্রজেক্টে বিলিয়ন ডলার লোকসান করে জাকারবার্গ সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেখান থেকে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তার ‘ইয়ার অব এফিশিয়েন্সি’ বা ব্যয় সংকোচন নীতি এবং ওপেন সোর্স এআই মডেল ‘লামা’ (Llama) রিলিজ করার সিদ্ধান্ত ছিল গেম চেঞ্জার। একদিকে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের রিলস (Reels) থেকে আসা বিজ্ঞাপনী আয়, অন্যদিকে এআই দুনিয়ায় মেটার শক্তিশালী অবস্থান- এই দুইয়ে মিলে জাকারবার্গ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিণত এবং শক্তিশালী।
জেনসেন হুয়াং সপ্তম
এআই দুনিয়ার ‘গডফাদার’ এই তালিকার সপ্তম নামটি সম্ভবত গত তিন বছরের সবচেয়ে বড় বিস্ময়। জেনসেন হুয়াং (১৫৮ বিলিয়ন ডলার)। এনভিডিয়া (Nvidia)-র সিইও। তার গায়ে সব সময় থাকে সিগনেচার কালো লেদার জ্যাকেট, আর মাথায় থাকে আগামীর চিপের নকশা। তাকে বলা হয় বর্তমান এআই বিপ্লবের ‘ইঞ্জিন মেকার’। কেন তিনি এত ধনী? উত্তরটা সহজ। সোনার খনিতে যারা সোনা খোঁজে, তারা সব সময় ধনী হয় না; কিন্তু যারা কোদাল বা বেলচা বিক্রি করে, তারা নিশ্চিত ধনী হয়। বর্তমান এআই যুগে এনভিডিয়ার চিপগুলো হলো সেই ‘বেলচা’। চ্যাটজিপিটি থেকে শুরু করে গুগলের এআই- সবকিছু চালানোর জন্য এনভিডিয়ার উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জিপিইউ (GPU) অপরিহার্য। এই একচ্ছত্র আধিপত্য বা মনোপলি তাকে রকেটের গতিতে শীর্ষ ১০-এ জায়গা করে দিয়েছে।
হার্ডওয়্যার কিং মাইকেল ডেল অষ্টমে
হার্ডওয়্যারের নীরব সম্রাট অষ্টম স্থানে থাকা মাইকেল ডেল (১৫২ বিলিয়ন ডলার) প্রমাণ করেছেন যে, ল্যাপটপ বা পিসির যুগ শেষ হয়ে গেলেও হার্ডওয়্যার ব্যবসা ফুরিয়ে যায়নি। ডেল টেকনোলজিস এখন কেবল পিসি বিক্রি করে না, তারা বিক্রি করে এআই সার্ভার। এআই কোম্পানিগুলোর ডেটা স্টোরেজ এবং সার্ভারের বিশাল চাহিদা মেটাতে ডেলের জুড়ি নেই। প্রচারের আলোয় না থেকেও তিনি নীরবে তার সাম্রাজ্য বাড়িয়ে চলেছেন।
প্রযুক্তির বাইরে ওয়ারেন বাফেট
প্রযুক্তির বাইরের দুই মহীরুহ প্রযুক্তির এই প্রবল ঝড়ের মধ্যেও শীর্ষ ১০-এ টিকে আছেন মাত্র দুজন ব্যক্তি, যারা সিলিকন ভ্যালির অংশ নন। নবম স্থানে আছেন ‘ওরাকল অব ওমাহা’ খ্যাত ওয়ারেন বাফেট (১৫২ বিলিয়ন ডলার)। ৯৫ বছর বয়সেও তিনি তার বিনিয়োগ কোম্পানি ‘বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে’ দিয়ে প্রমাণ করছেন, প্রযুক্তির বাইরেও স্মার্ট এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ (Value Investing) দিয়ে টিকে থাকা সম্ভব। কোকা-কোলা থেকে শুরু করে আমেরিকান এক্সপ্রেস- তার পোর্টফোলিও আজও অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের মতো।
কেন এই মার্কিন রাজত্ব?
সিলিকন ভ্যালির ইকোসিস্টেম : আমেরিকা এমন একটি ইকোসিস্টেম তৈরি করেছে, যেখানে স্ট্যানফোর্ড বা হার্ভার্ডের একজন ড্রপ-আউট ছাত্র গ্যারেজে বসে বিশ্বকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে এবং সেই স্বপ্নের জন্য কোটি ডলারের ফান্ডিংও পেয়ে যায়। ইউরোপ বা এশিয়ায় মেধা থাকলেও এই ‘রিস্ক টেকিং’ ইকোসিস্টেমের অভাব রয়েছে।
ওয়াল স্ট্রিটের ক্ষমতা : আমেরিকার শেয়ারবাজার (NYSE, NASDAQ) কোম্পানিগুলোকে যে পরিমাণ ‘ভ্যালুয়েশন’ বা মূল্য দেয়, তা অন্য কোনো দেশের শেয়ারবাজার দিতে পারে না। ডলারের বিশ্বব্যাপী আধিপত্য আমেরিকান ধনীদের সম্পদ ডলারে হিসাব করার কারণে তাদের সব সময় এগিয়ে রাখে।
স্কেলেবিলিটি বা বিস্তৃতি : শীর্ষ ১০ জনের ৮ জনই প্রযুক্তি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ‘স্কেলেবিলিটি’। একটি সফটওয়্যার বা এআই কোড একবার লিখলে তা কোনো বাড়তি খরচ ছাড়াই কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু একটি গাড়ি বা সাবান তৈরি করতে কাঁচামাল ও শ্রম লাগে। তাই প্রথাগত শিল্পপতির চেয়ে টেক-টাইকুনদের সম্পদ বাড়ে জ্যামিতিক হারে। বিল গেটসের প্রস্থান, নারীদের অনুপস্থিতি এবং আমেরিকার দাপট- এই বিষয়গুলো প্রমাণ করে যে, সম্পদের এই পাহাড় কেবল ব্যক্তিগত সাফল্যের গল্প নয়। এর পেছনে রয়েছে গভীর ভূ-রাজনৈতিক কৌশল, প্রযুক্তির পালাবদল এবং আমাদের সমাজের দীর্ঘদিনের লালিত বৈষম্য। ২০২৫ সালের এই তালিকা তাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে- প্রযুক্তি বিশ্বকে এগিয়ে নিলেও, সমতার পৃথিবী গড়তে আমাদের এখনও অনেক পথ পাড়ি দেওয়া বাকি।
মহীরুহের পতন ও লিঙ্গবৈষম্যের দেয়াল
তালিকার পেছনের সমাজবিজ্ঞান
এই তালিকাটি কেবল কে কত টাকার মালিক- তার খতিয়ান নয়; বরং এটি বিশ্ব অর্থনীতির পালাবদল, ভূ-রাজনীতি এবং সমাজব্যবস্থার এক নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। এই তালিকার দিকে তাকালে তিনটি বড় প্রশ্ন বা অসংগতি প্রকট হয়ে ওঠে : একসময়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজা বিল গেটস কেন আজ সেরা দশে নেই? কেন পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হওয়া সত্ত্বেও এই এলিট ক্লাবে তাদের কোনো প্রতিনিধি নেই? এবং কেন এই তালিকা শুধুই আমেরিকার জয়গান গাইছে? বিল গেটসের ‘স্বেচ্ছায় প্রস্থান’ ও এক যুগের অবসান গত তিন দশক ধরে ‘বিশ্বের শীর্ষ ধনী’ শব্দটির সমার্থক শব্দ ছিল ‘বিল গেটস’। ১৯৯৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় তিনি ছিলেন এই তালিকার মুকুটহীন সম্রাট। অথচ ২০২৫ সালের এই ডিসেম্বরে তিনি সেরা ১০-এর বাইরে। কেবল বিল গেটস নন, মেক্সিকোর টেলিকম টাইকুন কার্লোস স্লিম বা স্পেনের আমানসিও ওর্তেগার (Zara-র মালিক) মতো যারা একসময় শীর্ষ তিনে ছিলেন, তারাও এখন পেছনের সারিতে।
কেন এই পতন? বিল গেটসের ক্ষেত্রে এটি আসলে ব্যবসায়িক ব্যর্থতা নয়, বরং একটি সচেতন ও মহৎ ‘বেছে নেওয়া পথ’।
দানের মহত্ত্ব : বিল গেটস যদি তার অর্জিত সম্পদ নিজের কাছে ধরে রাখতেন এবং দান না করতেন, তবে আজকের দিনে তার সম্পদের পরিমাণ হতো প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলার- যা বর্তমান শীর্ষ ধনী ইলন মাস্কের চেয়েও অনেক বেশি। তিনি তার প্রাক্তন স্ত্রী মেলিন্ডার সঙ্গে মিলে গড়ে তুলেছেন ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’ এবং ‘গিভিং প্লেজ’ (Giving Pledge) নামক মুভমেন্টের মাধ্যমে নিজের সম্পদের সিংহভাগ জনকল্যাণে দান করে দিয়েছেন। ফোর্বসের মতে, তিনি স্বেচ্ছায় ধনীর তালিকা থেকে নিজের নাম মুছে মানবতার তালিকায় নাম লিখিয়েছেন।
যুগের পরিবর্তন : বিল গেটস ছিলেন ‘পার্সোনাল কম্পিউটার’ যুগের আইকন। কার্লোস স্লিম ছিলেন ‘টেলিযোগাযোগ’ যুগের। কিন্তু ২০২৫ সাল হলো ‘এআই এবং ডেটা’র যুগ। মাইক্রোসফটের শেয়ার এখনও চড়া হলেও গেটস তার শেয়ারের বড় অংশ অনেক আগেই বিক্রি করে কৃষিজমি ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করেছেন, যার বৃদ্ধি টেক-স্টকের মতো উল্কার গতির নয়।
ব্যক্তিগত ভাঙন : ২০২১ সালে মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটসের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ গেটসের সম্পদে বড়সড় ধস নামায়। সেটেলমেন্ট হিসেবে তাকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ হস্তান্তর করতে হয়, যা তাকে র?্যাংকিংয়ে নিচে নামিয়ে দেয়।
নারীরা কেন নেই? ‘গ্লাস সিলিং’ আজও অটুট শীর্ষ ১০ জনের তালিকায় চোখ বোলালে একটি হতাশাজনক চিত্র ফুটে ওঠে- একজনও নারী নেই। ১০ জনের সবাই পুরুষ। এটি বিশ্ব অর্থনীতিতে জেন্ডার গ্যাপ বা লিঙ্গবৈষম্যের একটি প্রকট ও নির্মম উদাহরণ।
ফ্রাঁসোয়াজ বেটানকোর্ট মেয়ার্স (LÕOréal-এর উত্তরাধিকারী) বা অ্যালিস ওয়ালটন (Walmart-এর উত্তরাধিকারী)- বিশ্বে অনেক নারী বিলিয়নিয়ার আছেন। কিন্তু তারা কেউ শীর্ষ ১০-এ নেই। এর মূল কারণ হলো ‘উৎস’।
উত্তরাধিকার বনাম প্রতিষ্ঠাতা : বর্তমানে যারা শীর্ষ ১০-এ আছেন (মাস্ক, পেইজ, বেজোস), তারা সবাই ‘সেলফ-মেড’ বা প্রতিষ্ঠাতা। তারা শূন্য থেকে সাম্রাজ্য গড়েছেন। অন্যদিকে, শীর্ষ ধনী নারীদের অধিকাংশই তাদের সম্পদ পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে (বাবা বা স্বামীর কাছ থেকে)।
স্টেম (STEM) শিক্ষায় ঘাটতি : গত ৩০ বছরে সিলিকন ভ্যালিতে যারা রাজত্ব করেছেন, তারা মূলত ইঞ্জিনিয়ার। দুর্ভাগ্যবশত, ৮০ ও ৯০-এর দশকে যখন এই কোম্পানিগুলো (গুগল, আমাজন) তৈরি হচ্ছিল, তখন কম্পিউটার সায়েন্স বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল নগণ্য। সেই কাঠামোগত ঘাটতির ফলাফল আজ ২০২৫ সালে দেখা যাচ্ছে।
ভেঞ্চার ক্যাপিটালের বৈষম্য : পরিসংখ্যান বলছে, স্টার্টআপ ফান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে নারীরা এখনও পুরুষদের তুলনায় অনেক কম বিনিয়োগ পান। বিনিয়োগকারীরা পুরুষ সিইওদের ওপর বাজি ধরতে যতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, নারীদের ওপর ততটা নন। সমাজ নারীদের ‘নিরাপদ’ পেশায় দেখতে চায়, কিন্তু বিলিয়ন ডলারের ঝুঁকি নেওয়া ‘খামখেয়ালি উদ্যোক্তা’ হিসেবে মেনে নিতে এখনও কুণ্ঠাবোধ করে।
আমেরিকা ও প্রযুক্তির একচ্ছত্র আধিপত্য এই তালিকার আরেকটি বিস্ময়কর দিক হলো আমেরিকার আধিপত্য। ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই মার্কিন নাগরিক (ব্যতিক্রম শুধু ফ্রান্সের বার্নার্ড আর্নল্ট)। চীন বা ভারতের মতো বিশাল অর্থনীতির দেশ থেকেও কেউ শীর্ষ ১০-এ নেই (মুকেশ আম্বানি বা গৌতম আদানিরা ১১-১৫ তম স্থানের দিকে ঘোরাফেরা করছেন)।

রিপোর্টারের নাম 























