মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আজ মহান বিজয় দিবস

আজ মহান বিজয় দিবস; সবুজ জমিনে লাল-সুর্যখচিত স্বাধীন একটি নিশান অর্জনের দিন। বীরত্বগাথা গৌরবোজ্জ্বল সেই অর্জনের ৫৪ বছর পেরিয়ে আজ ৫৫ বছরে পদার্পণ করল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল শোষণহীন বৈষম্যমুক্ত ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ ও দেশ প্রতিষ্ঠা করা। সেই প্রত্যাশা নিয়েই জাতি আজ পালন করবে বিশেষ এই দিনটি।

বিশিষ্টজনরা বলছেন, স্বাধীনতার এত বছরেও আমাদের প্রত্যাশিত রাষ্ট্র গঠন হয়নি। শোষণহীন বৈষম্যমুক্ত ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ গড়ে ওঠেনি। ’৭১-এর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে এক নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর এবারের বিজয় দিবস জাতির সামনে এক নতুন প্রত্যাশা নিয়ে হাজির হয়েছে।

শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক আগামী বাংলাদেশ গঠন করার প্রত্যাশায় আজ নানা আয়োজনে বিজয় দিবস উদযাপন করা হবে। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হলে গণতন্ত্রকে আর শক্তিশালী ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং ঐক্যের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এবারের বিজয় দিবস হোক জাতীয় জীবনে নতুনভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে যে নবযাত্রা সূচিত হয়েছে, তা যে কোনো মূল্যে রক্ষার শপথ নেওয়ার দিন।

একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি মানচিত্র ও একটি পতাকা মানুষের হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন। ব্রিটিশ শাসন থেকে পাকিস্তান সময়ের শোষণ ও নির্যাতনের পিছু থেকে এই ভুবনেই মানুষের মানসপটে স্বাধীনতার স্বপ্ন আরও জেঁকে বসে। স্বাধীনতার স্বপ্ন বহুযুগ ধরে বাংলার মানুষের পথপরিক্রমায় একত্রীকৃত হয়ে ১৯৭১ সালে সাফল্যে পৌঁছায়। পাকিস্তানি শাসনের নিচে থেকে মুক্তি পেতে তারা অকাতরে আত্মসমর্পণ করে এক সাগর রক্তে স্বাধীনতার দাম পরিশোধ করে। পরাধীন এক জাতি পায় মুক্তির স্বাদ, নজির গড়ে নতুন পরিচয় লাভ করে।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক বাণীতে বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ডাকে শুরু হওয়া স্বাধীনতাযুদ্ধ ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়, পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করার মাধ্যমে। দেশের অদম্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবনবাজি রেখে এ বিজয় ছিনিয়ে আনে। তাই ১৬ ডিসেম্বর জাতির অহংকার, আনন্দ আর বেদনার এক মহাকাব্যিক দিন। ১৯৭১-এ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত হলেও চক্রান্তকারীদের নীলনকশা এখনও চলমান। একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশের জন্য এই বিজয়ের দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোকÑ আমরা বিভাজন ভুলে, হিংসা ভুলে মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে থাকব। আজকের এ মহান দিনে আমি মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই।

আজ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রস্তুত গোটা বাংলাদেশ। বিজয়ের দিনে দেশের সর্বত্র দেশে জাতীয় পতাকা উড়বে। আগামী প্রক্রিয়ায় দাঁড়িয়ে জাতি শপথ নেবে অন্যায়, শোষণ ও দুর্নীতি থাকবে না; মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হবে না; ক্ষমতার অপব্যবহার আর থাকবে না। আজ শপথ নেবে সমৃদ্ধিশালী, উন্নত ও মানবতাভিত্তিক একটি দেশ গড়ার জন্য। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টিকারীদের নির্মূল করার অঙ্গীকার গ্রহণ করা হবে।

স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক, ডাকসুর সাবেক ভিপি, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, সুদীর্ঘ লড়াইয়ের পর ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থান চরম সত্যটি উন্মোচিত করেছে যে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, তার অভ্যন্তরে এখনও সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারভিত্তিক প্রজাতন্ত্র অনুপস্থিত।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, এবারকার বিজয় দিবস নতুন প্রত্যাশার দ্বার উন্মোচন করেছে। বিশেষ করে দীর্ঘ ১৬ বছর পর আমরা একটা অসাধারণ গণজাগরণ ও গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন বিজয় পেয়েছি। তাই এবারের বিজয় দিবস বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাতির আকাক্সক্ষা ছিল এই লড়াই যেন চূড়ান্ত লড়াই হয়, যাতে আমরা একটা সমাজ পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাই। কিন্তু নয় মাস যুদ্ধ শেষে যে বিজয় আমরা অর্জন করেছিলাম, সময়ের ফাঁকফোকরে তা মøান হয়ে গেছে।

বিজয় দিবস-২০২৫ উদযাপন উপলক্ষে আজ ১৬ ডিসেম্বরের ভোরে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সকাল ৬টা ৩৪ মিনিটে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এর পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠের পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এ ছাড়া দেশের সব স্তরে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবন এবং দেশের বাইরের বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতেও জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও আলোকসজ্জা করা হবে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপে জাতীয় পতাকা, ব্যানার ও রঙিন নকশায় সজ্জিত করা হবে।

এই দিনে দেশের বিমানবন্দরগুলোতে, বিশেষ করে পুরাতন বিমানবন্দরে, নৌ ও বিমানবাহিনী পৃথক ফ্লাই-পাস্ট মহড়া পরিচালনা করবে। থাকবে ব্যান্ড-শো ও অন্য সাংস্কৃতিক কর্মসূচি। গত বছরের মতোই এবারও দেশের জলো-উপজেলায় আড়ম্বরপূর্ণ বিজয়মঞ্চে অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ৯টায় বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, কুচকাওয়াজ ও প্রদর্শনী থাকবে।

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ঢাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করেছে আক্রোবেটিক শো ও সন্ধ্যায় যাত্রাপালা। এদিন সারা দেশে ৬৪ জেলায় একযোগে স্বাধীন বাংলা ব্রাত্যের কেন্দ্রের গান পরিবেশিত হবে, যেখানে নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা অংশ নেবেন।

রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনে বিকালে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা দেবেন। মহানগর, জেলায় ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকবে। ডাক বিভাগ স্মারক ডাকটিকিট ছাপাবে। দেশের টেলিভিশন ও গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে এবং সকল মিউজিয়াম ও শিশু বর্ণমালা প্রতিষ্ঠান উন্মুক্ত রাখা হবে। সিনেমা হলগুলোতেও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শন হবে।

চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলা ও পায়রা বন্দর, ঢাকার সদরঘাটসহ বিভিন্ন ঘাটে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের প্রদর্শনী থাকবে। সকাল ৯টা থেকে বিকাল পর্যন্ত জনসাধারণের জন্য এসব প্রদর্শনী উন্মুক্ত থাকবে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার মাগফিরাত এবং শান্তি ও অগ্রগতির জন্য দেশের সব মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা ও মোনাজাতের আয়োজন করা হবে।

আজকের এই মহান দিনে সব শ্রদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ, শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের। জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে প্রতিটি পৌর এলাকায় বিজয়ের স্মৃতিচারণ ও উদযাপন হবে শপথ হবে, আমরা একত্রে নতুন বাংলাদেশ গড়ব, যেখানে থাকবে মানবতা, ন্যায় ও সমতা।

ঢাবিতে দিনব্যাপী কর্মসূচি

মহান বিজয় দিবস উদযাপনে দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের সভাপতিত্বে এক সভায় এসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।

কর্মসূচি অনুযায়ী, মঙ্গলবার সকাল ৬টা ২০ মিনিটে উপাচার্য ভবনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল সাড়ে ৬টায় উপাচার্য ভবনসংলগ্ন স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জমায়েত অনুষ্ঠিত হবে। এর পর সকাল ৬টা ৩৫ মিনিটে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পুষ্পস্তবক অর্পণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে।

কর্মসূচির অংশ হিসেবে সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন মসজিদে শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে বিশেষ দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতেও শহীদদের আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।

দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরতে কলা ভবন, কার্জন হল, টিএসসি ও স্মৃতি চিরন্তনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। পাশাপাশি আবাসিক হলসমূহে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মহান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্র প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন থাকবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সর্বাধিক পঠিত

আজ মহান বিজয় দিবস

প্রকাশিত সময় : ১০:২৩:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫

আজ মহান বিজয় দিবস; সবুজ জমিনে লাল-সুর্যখচিত স্বাধীন একটি নিশান অর্জনের দিন। বীরত্বগাথা গৌরবোজ্জ্বল সেই অর্জনের ৫৪ বছর পেরিয়ে আজ ৫৫ বছরে পদার্পণ করল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল শোষণহীন বৈষম্যমুক্ত ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ ও দেশ প্রতিষ্ঠা করা। সেই প্রত্যাশা নিয়েই জাতি আজ পালন করবে বিশেষ এই দিনটি।

বিশিষ্টজনরা বলছেন, স্বাধীনতার এত বছরেও আমাদের প্রত্যাশিত রাষ্ট্র গঠন হয়নি। শোষণহীন বৈষম্যমুক্ত ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ গড়ে ওঠেনি। ’৭১-এর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে এক নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর এবারের বিজয় দিবস জাতির সামনে এক নতুন প্রত্যাশা নিয়ে হাজির হয়েছে।

শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক আগামী বাংলাদেশ গঠন করার প্রত্যাশায় আজ নানা আয়োজনে বিজয় দিবস উদযাপন করা হবে। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হলে গণতন্ত্রকে আর শক্তিশালী ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং ঐক্যের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এবারের বিজয় দিবস হোক জাতীয় জীবনে নতুনভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া ও গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে যে নবযাত্রা সূচিত হয়েছে, তা যে কোনো মূল্যে রক্ষার শপথ নেওয়ার দিন।

একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি মানচিত্র ও একটি পতাকা মানুষের হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন। ব্রিটিশ শাসন থেকে পাকিস্তান সময়ের শোষণ ও নির্যাতনের পিছু থেকে এই ভুবনেই মানুষের মানসপটে স্বাধীনতার স্বপ্ন আরও জেঁকে বসে। স্বাধীনতার স্বপ্ন বহুযুগ ধরে বাংলার মানুষের পথপরিক্রমায় একত্রীকৃত হয়ে ১৯৭১ সালে সাফল্যে পৌঁছায়। পাকিস্তানি শাসনের নিচে থেকে মুক্তি পেতে তারা অকাতরে আত্মসমর্পণ করে এক সাগর রক্তে স্বাধীনতার দাম পরিশোধ করে। পরাধীন এক জাতি পায় মুক্তির স্বাদ, নজির গড়ে নতুন পরিচয় লাভ করে।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক বাণীতে বলেছেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ডাকে শুরু হওয়া স্বাধীনতাযুদ্ধ ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়, পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করার মাধ্যমে। দেশের অদম্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবনবাজি রেখে এ বিজয় ছিনিয়ে আনে। তাই ১৬ ডিসেম্বর জাতির অহংকার, আনন্দ আর বেদনার এক মহাকাব্যিক দিন। ১৯৭১-এ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি শত্রুমুক্ত হলেও চক্রান্তকারীদের নীলনকশা এখনও চলমান। একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশের জন্য এই বিজয়ের দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোকÑ আমরা বিভাজন ভুলে, হিংসা ভুলে মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে থাকব। আজকের এ মহান দিনে আমি মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই।

আজ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রস্তুত গোটা বাংলাদেশ। বিজয়ের দিনে দেশের সর্বত্র দেশে জাতীয় পতাকা উড়বে। আগামী প্রক্রিয়ায় দাঁড়িয়ে জাতি শপথ নেবে অন্যায়, শোষণ ও দুর্নীতি থাকবে না; মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হবে না; ক্ষমতার অপব্যবহার আর থাকবে না। আজ শপথ নেবে সমৃদ্ধিশালী, উন্নত ও মানবতাভিত্তিক একটি দেশ গড়ার জন্য। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টিকারীদের নির্মূল করার অঙ্গীকার গ্রহণ করা হবে।

স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক, ডাকসুর সাবেক ভিপি, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেছেন, সুদীর্ঘ লড়াইয়ের পর ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থান চরম সত্যটি উন্মোচিত করেছে যে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, তার অভ্যন্তরে এখনও সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারভিত্তিক প্রজাতন্ত্র অনুপস্থিত।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, এবারকার বিজয় দিবস নতুন প্রত্যাশার দ্বার উন্মোচন করেছে। বিশেষ করে দীর্ঘ ১৬ বছর পর আমরা একটা অসাধারণ গণজাগরণ ও গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন বিজয় পেয়েছি। তাই এবারের বিজয় দিবস বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাতির আকাক্সক্ষা ছিল এই লড়াই যেন চূড়ান্ত লড়াই হয়, যাতে আমরা একটা সমাজ পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাই। কিন্তু নয় মাস যুদ্ধ শেষে যে বিজয় আমরা অর্জন করেছিলাম, সময়ের ফাঁকফোকরে তা মøান হয়ে গেছে।

বিজয় দিবস-২০২৫ উদযাপন উপলক্ষে আজ ১৬ ডিসেম্বরের ভোরে ঢাকায় ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সকাল ৬টা ৩৪ মিনিটে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এর পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বীরশ্রেষ্ঠের পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এ ছাড়া দেশের সব স্তরে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবন এবং দেশের বাইরের বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতেও জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও আলোকসজ্জা করা হবে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপে জাতীয় পতাকা, ব্যানার ও রঙিন নকশায় সজ্জিত করা হবে।

এই দিনে দেশের বিমানবন্দরগুলোতে, বিশেষ করে পুরাতন বিমানবন্দরে, নৌ ও বিমানবাহিনী পৃথক ফ্লাই-পাস্ট মহড়া পরিচালনা করবে। থাকবে ব্যান্ড-শো ও অন্য সাংস্কৃতিক কর্মসূচি। গত বছরের মতোই এবারও দেশের জলো-উপজেলায় আড়ম্বরপূর্ণ বিজয়মঞ্চে অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ৯টায় বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, কুচকাওয়াজ ও প্রদর্শনী থাকবে।

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ঢাকা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করেছে আক্রোবেটিক শো ও সন্ধ্যায় যাত্রাপালা। এদিন সারা দেশে ৬৪ জেলায় একযোগে স্বাধীন বাংলা ব্রাত্যের কেন্দ্রের গান পরিবেশিত হবে, যেখানে নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা অংশ নেবেন।

রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনে বিকালে বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা দেবেন। মহানগর, জেলায় ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকবে। ডাক বিভাগ স্মারক ডাকটিকিট ছাপাবে। দেশের টেলিভিশন ও গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে এবং সকল মিউজিয়াম ও শিশু বর্ণমালা প্রতিষ্ঠান উন্মুক্ত রাখা হবে। সিনেমা হলগুলোতেও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শন হবে।

চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলা ও পায়রা বন্দর, ঢাকার সদরঘাটসহ বিভিন্ন ঘাটে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের প্রদর্শনী থাকবে। সকাল ৯টা থেকে বিকাল পর্যন্ত জনসাধারণের জন্য এসব প্রদর্শনী উন্মুক্ত থাকবে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার মাগফিরাত এবং শান্তি ও অগ্রগতির জন্য দেশের সব মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা ও মোনাজাতের আয়োজন করা হবে।

আজকের এই মহান দিনে সব শ্রদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ, শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের। জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে প্রতিটি পৌর এলাকায় বিজয়ের স্মৃতিচারণ ও উদযাপন হবে শপথ হবে, আমরা একত্রে নতুন বাংলাদেশ গড়ব, যেখানে থাকবে মানবতা, ন্যায় ও সমতা।

ঢাবিতে দিনব্যাপী কর্মসূচি

মহান বিজয় দিবস উদযাপনে দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের সভাপতিত্বে এক সভায় এসব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।

কর্মসূচি অনুযায়ী, মঙ্গলবার সকাল ৬টা ২০ মিনিটে উপাচার্য ভবনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল সাড়ে ৬টায় উপাচার্য ভবনসংলগ্ন স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জমায়েত অনুষ্ঠিত হবে। এর পর সকাল ৬টা ৩৫ মিনিটে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পুষ্পস্তবক অর্পণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে।

কর্মসূচির অংশ হিসেবে সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) মিলনায়তনে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন মসজিদে শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে বিশেষ দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। একই সঙ্গে অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতেও শহীদদের আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।

দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরতে কলা ভবন, কার্জন হল, টিএসসি ও স্মৃতি চিরন্তনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। পাশাপাশি আবাসিক হলসমূহে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মহান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্র প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন থাকবে।