১৭ বছরেরও বেশি সময় পর আগামীকাল ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এমন এক সময় তিনি আসছেন যখন একদিকে দেশ গভীর রাজনৈতিক শূন্যতায়, অন্যদিকে সামনেই জাতীয় নির্বাচন। উপরন্তু অনেকটাই ভেঙে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা; প্রতিনিয়ত বাড়ছে সহিংসতা, জনমনে ক্রমেই বাড়ছে আতঙ্ক-উদ্বেগ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় দল-মত নির্বিশেষে পুরো দেশ। তাকে বরণ করে নিতে সার্বিকভাবে প্রস্তুত রাজধানী ঢাকা।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। তিনি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অন্যদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন ভারতে। প্রায় চার দশক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এই দুই নেত্রীই এখন কার্যত রাজপথের বাইরে। ফলে দেশে তৈরি হয়েছে বড় ধরনের নেতৃত্বশূন্যতা। এর মধ্যে দেশে বাড়ছে অরাজকতা। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নেই। চরম ডানপন্থিদের অপতৎপরতা বেড়েছে। টার্গেট কিলিং ও মবসন্ত্রাস আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। শীর্ষ গণমাধ্যমে হামলার ঘটনাও দেশকে নাড়া দিয়েছে। রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন। এমন বাস্তবতায় দেশের মানুষের একটাই চাওয়াÑ ভয়মুক্ত, স্থিতিশীল
বাংলাদেশ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সেই প্রত্যাশার কেন্দ্রে এখন তারেক রহমান। তাকে স্বাগত জানাতে রাজধানীর ৩০০ ফুট সড়কে বিশাল মঞ্চ নির্মাণ করছে বিএনপি। উন্মুখ দলটির নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষও। কাজেই তারেক রহমানের এ দেশে ফেরা শুধু একটি প্রত্যাবর্তনই নয়। অনেকের চোখে এটি দেশের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
তারেক রহমানকে সংবর্ধনা দিতে রাজধানীর তিনশ ফিট এলাকায় বিশ্ব রোডে পূর্বাচলমুখী ৩০০ ফিট সড়কে তৈরি করা মঞ্চ গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে পরিদর্শনে যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে করা অভ্যর্থনা কমিটির সদস্য সচিব ও বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী?। এ সময় তিনি বলেন, দীর্ঘ ১৭ বছর পর দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার সংবর্ধনায় মানুষের মহামিলন হবে। আমরা অর্ধকোটি মানুষের উপস্থিতি আশা করছি।
রিজভী বলেন, অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি দল থেকেও সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সরকারও তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিয়ে আন্তরিক। দলীয়ভাবে নেতাকর্মীরাও তার নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি জানান, দেশে পৌঁছানোর পর তারেক রহমান প্রথমে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। এরপর এভারকেয়ার হাসপাতালে তার মা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে দেখতে যাবেন।
নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপির এই সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, জনসমাগম যত বড়ই হোক, সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করতে হবে। রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে প্রিয় নেতাকে শুভেচ্ছা জানাবেন। কোনো বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতা করা যাবে না। তিনি (তারেক রহমান) তার মাকে দেখে বাসায় পৌঁছানো পর্যন্ত সবাই শৃঙ্খলার সঙ্গে অবস্থান করবেন।
বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে রাজধানী
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে স্বাগত জানিয়ে ব্যানার-বিলবোর্ডে ছেয়ে গেছে রাজধানী। দলটির নেতাকর্মীরা নগরীর প্রধান সড়ক, অলি-গলি ও গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ঝুলিয়েছেন ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার ও বিলবোর্ড। এতে বড় অক্ষরে লেখাÑ ‘লিডার আসছে’, ‘হে বিজয়ী বীর, তোমাকে স্বাগত’ ইত্যাদি। রাজধানীর পল্টন, মৎস্য ভবন মোড়, কাকরাইল, মোহাম্মদপুর, কারওয়ানবাজার, মহাখালী, গুলশান, উত্তরা, বনানী, বাড্ডাসহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে গতকাল এমন চিত্র দেখা গেছে। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পক্ষ থেকে সাঁটা এসব ব্যানার-বিলবোর্ডে বড় আকারে শোভা পেয়েছে তারেক রহমানের ছবি।
শাহজালাল বিমানবন্দরে আজ বুধবার সন্ধ্যা থেকে ২৪ ঘণ্টা দর্শনার্থী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া আগামীকাল আগেভাগে পৌঁছাতে যাত্রীদের অনুরোধ করা হয়েছে। গতকাল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের জারি করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আজ বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে কাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। যাত্রীসেবা, নিরাপত্তা ও কার্যক্রমের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, এ সময়ের মধ্যে বৈধ টিকিটধারী যাত্রী ছাড়া অন্য কোনো সঙ্গী বা দর্শনার্থী বিমানবন্দর এলাকায় প্রবেশ করতে পারবেন না। সাময়িক এ বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে যাত্রী এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের কাছে আন্তরিক সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী বৃহস্পতিবার (কাল) শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকা, গুলশান সংযোগ সড়ক এবং পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়েতে (তিনশ ফিট) ব্যাপক জনসমাগমের সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে এ দিন এলাকাগুলোতে বড় ধরনের যানজট হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকÑ উভয় রুটের সম্মানিত যাত্রীদের অনাকাক্সিক্ষত ভোগান্তি এড়াতে বিশেষ অনুরোধ জানানো হয়েছে। যাত্রীরা যেন নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই বিমানবন্দরে পৌঁছানোর প্রস্তুতি নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। যাত্রীদের এ সহযোগিতা ওই দিনের ভ্রমণকে নির্বিঘ্ন, আনন্দদায়ক ও ঝামেলামুক্ত করতে সহায়তা করবে বলে আশা প্রকাশ করেছে বিমান কর্তৃপক্ষ।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারেক রহমান ১১টা ৫৫ মিনিটে ঢাকায় অবতরণ করবেন। তার যাত্রাসঙ্গী হচ্ছেন স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান এবং একমাত্র কন্যা ব্যারিস্টার জাইমা রহমান। বিমানবন্দরে তাদের স্বাগত জানাবেন দলের মহাসচিব, জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যবৃন্দ ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব। তাদের মধ্যে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাবেন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত সব কার্যক্রম শেষে তারেক রহমান স্ত্রী ও কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে মা খালেদা জিয়াকে দেখতে যাবেন এভারকেয়ার হাসপাতালে। পথে রাজধানীর তিনশ ফুট সড়কে অভ্যত্থনা মঞ্চে উঠে দেশবাসীকে ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানাবেন। এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাকে দেখে গুলশানের ভাড়া বাসা ফিরোজায় উঠবেন তারেক রহমান। পাশে গুলশান অ্যাভিনিউর ১৯৬ নম্বর বাসায় থাকবে তারেক রহমানের পরিবার। ইতোমধ্যে গুলশান ও নয়াপল্টনে তারেক রহমানের জন্য অফিস প্রস্তুত করা হয়েছে।
এদিকে তারেক রহমানের নিরাপত্তার বিষয়ে গত কয়েক দিন ধরে সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রধানদের সঙ্গে বিএনপি গঠিত নিরাপত্তা টিমের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম শামসুল ইসলামের নেতৃত্বে সদস্যরা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। নিয়মিত গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেলসহ তার টিমের সদস্যরা।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রিয় নেতা তারেক রহমানকে স্বাগত জানাতে সারাদেশ থেকে নেতাকর্মীরা আসবেন। প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যন্ত বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আজ ২৪ ডিসেম্বর রাতের মধ্যে অথবা ২৫ ডিসেম্বর সকালের মধ্যে তারা ঢাকায় আসবেন। এর মধ্যে সারাদেশে জনগণের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘ ১৭ বছরের কষ্টের নির্বাসিত জীবন শেষে এদেশের গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ, আমাদের আগামীর বাংলাদেশের যিনি নেতৃত্ব দেবেন, গণতন্ত্র অবমুক্ত করতে যিনি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সুদীর্ঘ ১৭ বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইনশাআল্লাহ সেই নেতাকে একনজর দেখার জন্য সারাদেশ থেকে লোকজন আসবেন।
বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, আমরা চাই, বিগত ৫৫ বছরের ইতিহাসে যা কিছু দৃষ্টান্ত বা রেকর্ড হয়েছে, এ অনুষ্ঠান যেন সেসব ছাড়িয়ে যায় এবং আগামী ৫৫ বছরের ইতিহাসেও যেন এ রকম কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা না হয়, সে রকম স্মরণীয় করে রাখার জন্যই আমাদের সব আয়োজন। এ দিনটির জন্য বাংলাদেশের মানুষ অপেক্ষা করছে। তিনি যোগ করেন, এক্ষেত্রে আপনাদের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। যথাসময়ে গণমাধ্যমকে সবকিছুই জানানো হবে, বলেন তিনি।
এদিকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসার সুবিধার্থে বিশেষ ট্রেন ও বগি রিজার্ভ করেছে বিএনপি। এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থও পরিশোধ করা হয়েছে বলে বিএনপি সূত্রে জানা যায়। কক্সবাজার-ঢাকা, সিলেট-ঢাকা, জামালপুর-ময়মনসিংহ-ঢাকা, টাঙ্গাইল-ঢাকা, চাঁপাইনব্বাগঞ্জ-রাজশাহী-ঢাকা, পঞ্চগড়-নীলফামারী-পার্বতীপুর-ঢাকা ও কুড়িগ্রাম-রংপুর-ঢাকা রুটে ট্রেন যোগে ঢাকায় আসবেন বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা।

ডেইলি দেশ নিউজ ডটকম ডেস্ক 























