মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রাজনীতিতে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াণ মানে কেবল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন নেত্রীর চলে যাওয়া নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক সময়ের নিঃশব্দ সমাপ্তি। যিনি আপসহীনতার রাজনীতিকে নিজের পরিচয়ে রূপ দিয়েছিলেন, যার নামের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আন্দোলন, সংঘাত, প্রতিরোধ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব—তার রাজনৈতিক উপস্থিতি ক্ষীণ হয়ে আসা মানেই রাজনীতির মানচিত্রে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি।

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ক্ষমতায় যেমন দৃঢ় ছিলেন, ক্ষমতার বাইরে থেকেও তেমনি ছিলেন অনমনীয়। কোনো অবস্থান থেকে সরে আসা, রাজনৈতিক সমঝোতায় ঝোঁকা কিংবা প্রতিপক্ষের সঙ্গে বোঝাপড়ার রাজনীতি—এসব তার রাজনৈতিক চরিত্রের অংশ ছিল না। এই আপসহীনতা তাকে যেমন দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে এক আপসহীন সাহসের প্রতীক বানিয়েছে, তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনায় অচলাবস্থার জন্য তাকে দায়ী করার সুযোগও দিয়েছে বিরোধীদের।

২০০৮ সালের পর থেকে তার রাজনীতি আর ক্ষমতাকেন্দ্রিক থাকেনি; সেটি রূপ নেয় প্রতিরোধের রাজনীতিতে। নির্বাচন বর্জন, আন্দোলনের ডাক, রাজপথের সংঘাত এবং একের পর এক মামলার ভারে তার রাজনৈতিক পরিসর ক্রমেই সংকুচিত হতে থাকে। দীর্ঘ কারাবাস ও শারীরিক অসুস্থতা তাকে রাজপথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, কিন্তু দলীয় রাজনীতিতে তার নাম কখনোই গুরুত্ব হারায়নি। সিদ্ধান্তের শেষ কথা, রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা কিংবা প্রতীকী নেতৃত্ব—সবকিছুর কেন্দ্রে থেকেছেন খালেদা জিয়াই। এই কারণেই তার বিদায় বিএনপির জন্য কেবল নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রশ্ন নয়, বরং অস্তিত্বের প্রশ্ন।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল আপস না করা। সময়ের সঙ্গে রাজনীতি বদলেছে, কৌশল বদলেছে, কিন্তু তার অবস্থান বদলায়নি—এমনটাই বিশ্বাস করেন তার অনুসারীরা। আবার সমালোচকদের চোখে এই অনমনীয়তাই তাকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে দেয়নি। তবু ইতিহাস অস্বীকার করতে পারবে না যে, সামরিক শাসন-পরবর্তী বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পথচলায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার রাজনীতিতে খালেদা জিয়া ছিলেন এক অপরিহার্য চরিত্র।

যদি আজ তার রাজনৈতিক বিদায় অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে ওঠে, তবে সেটি একটি অধ্যায়ের শেষ। সামনে বিএনপিকে নতুন নেতৃত্ব, নতুন কৌশল এবং হয়তো নতুন রাজনৈতিক দর্শনের পথে হাঁটতে হবে। কিন্তু যে রাজনীতি আপসহীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল, যে রাজনীতি ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিক নেতৃত্বের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল—তার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হবে না। খালেদা জিয়ার বিদায়ের সঙ্গে তাই একটি প্রশ্নও থেকে যায়—বাংলাদেশের রাজনীতি কি আরও সমঝোতার পথে যাবে, নাকি সংঘাতের পুরোনো বৃত্তেই ঘুরপাক খাবে?

ইতিহাসে খালেদা জিয়া থাকবেন ভিন্ন ভিন্ন মূল্যায়নে—কারও কাছে গণতন্ত্রের নেত্রী, কারও কাছে সংঘাতের রাজনীতির মুখ। কিন্তু একটি সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই, তিনি ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস অসম্পূর্ণ। তার বিদায় মানে একজন ব্যক্তির প্রস্থান নয়, বরং এক ধরনের রাজনীতির নীরব অবসান।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সর্বাধিক পঠিত

রাজনীতিতে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি

প্রকাশিত সময় : ১১:৩৮:১২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াণ মানে কেবল বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন নেত্রীর চলে যাওয়া নয়, বরং এটি একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক সময়ের নিঃশব্দ সমাপ্তি। যিনি আপসহীনতার রাজনীতিকে নিজের পরিচয়ে রূপ দিয়েছিলেন, যার নামের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আন্দোলন, সংঘাত, প্রতিরোধ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব—তার রাজনৈতিক উপস্থিতি ক্ষীণ হয়ে আসা মানেই রাজনীতির মানচিত্রে এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি।

তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ক্ষমতায় যেমন দৃঢ় ছিলেন, ক্ষমতার বাইরে থেকেও তেমনি ছিলেন অনমনীয়। কোনো অবস্থান থেকে সরে আসা, রাজনৈতিক সমঝোতায় ঝোঁকা কিংবা প্রতিপক্ষের সঙ্গে বোঝাপড়ার রাজনীতি—এসব তার রাজনৈতিক চরিত্রের অংশ ছিল না। এই আপসহীনতা তাকে যেমন দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে এক আপসহীন সাহসের প্রতীক বানিয়েছে, তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনায় অচলাবস্থার জন্য তাকে দায়ী করার সুযোগও দিয়েছে বিরোধীদের।

২০০৮ সালের পর থেকে তার রাজনীতি আর ক্ষমতাকেন্দ্রিক থাকেনি; সেটি রূপ নেয় প্রতিরোধের রাজনীতিতে। নির্বাচন বর্জন, আন্দোলনের ডাক, রাজপথের সংঘাত এবং একের পর এক মামলার ভারে তার রাজনৈতিক পরিসর ক্রমেই সংকুচিত হতে থাকে। দীর্ঘ কারাবাস ও শারীরিক অসুস্থতা তাকে রাজপথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, কিন্তু দলীয় রাজনীতিতে তার নাম কখনোই গুরুত্ব হারায়নি। সিদ্ধান্তের শেষ কথা, রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা কিংবা প্রতীকী নেতৃত্ব—সবকিছুর কেন্দ্রে থেকেছেন খালেদা জিয়াই। এই কারণেই তার বিদায় বিএনপির জন্য কেবল নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রশ্ন নয়, বরং অস্তিত্বের প্রশ্ন।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল আপস না করা। সময়ের সঙ্গে রাজনীতি বদলেছে, কৌশল বদলেছে, কিন্তু তার অবস্থান বদলায়নি—এমনটাই বিশ্বাস করেন তার অনুসারীরা। আবার সমালোচকদের চোখে এই অনমনীয়তাই তাকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে দেয়নি। তবু ইতিহাস অস্বীকার করতে পারবে না যে, সামরিক শাসন-পরবর্তী বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পথচলায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার রাজনীতিতে খালেদা জিয়া ছিলেন এক অপরিহার্য চরিত্র।

যদি আজ তার রাজনৈতিক বিদায় অনিবার্য বাস্তবতা হয়ে ওঠে, তবে সেটি একটি অধ্যায়ের শেষ। সামনে বিএনপিকে নতুন নেতৃত্ব, নতুন কৌশল এবং হয়তো নতুন রাজনৈতিক দর্শনের পথে হাঁটতে হবে। কিন্তু যে রাজনীতি আপসহীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল, যে রাজনীতি ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিক নেতৃত্বের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল—তার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হবে না। খালেদা জিয়ার বিদায়ের সঙ্গে তাই একটি প্রশ্নও থেকে যায়—বাংলাদেশের রাজনীতি কি আরও সমঝোতার পথে যাবে, নাকি সংঘাতের পুরোনো বৃত্তেই ঘুরপাক খাবে?

ইতিহাসে খালেদা জিয়া থাকবেন ভিন্ন ভিন্ন মূল্যায়নে—কারও কাছে গণতন্ত্রের নেত্রী, কারও কাছে সংঘাতের রাজনীতির মুখ। কিন্তু একটি সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই, তিনি ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস অসম্পূর্ণ। তার বিদায় মানে একজন ব্যক্তির প্রস্থান নয়, বরং এক ধরনের রাজনীতির নীরব অবসান।