নেতাজি ইন্ডোরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সবে বলতে শুরু করেছেন। বাঁ’দিকের গ্যালারি থেকে ভেসে আসছিল স্লোগানের কলরব। অভিষেকের কথার মধ্যেই কর্ডলেস মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতে শুরু করলেন, ‘‘এই বাঁ’দিকের উপরে, আপনারা শান্ত হয়ে বসুন। শান্ত হোন!’’
অভিষেকও বলতে থাকেন, ‘‘আপনারা শান্ত হোন।’’ থেমে যায় কলরব। আবার বলতে শুরু করেন অভিষেক। তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা সম্ভবত শুরুতেই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, দল করতে হবে সুশৃঙ্খল হয়েই। দলীয় শৃঙ্খলার সেই বার্তাই হুঁশিয়ারির মোড়কে নিজের বক্তৃতার সময় আরও একবার দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। লক্ষ্য ২০২৬ সালের ভোটে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফেরা। তার আগে সংগঠনে শৃঙ্খলার বেড়ি পরালেন মমতা।
গত নভেম্বরে জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকের পরেই শৃঙ্খলার বিষয়ে আপসহীনতার কথা বলেছিল তৃণমূল। তার পরবর্তীকালে নানা মন্তব্যের জন্য ভরতপুরের বিধায়ক হুমায়ুন কবীর, অশোকনগরের বিধায়ক নারায়ণ গোস্বামীদের শো-কজ় করেছিল দল। পরামর্শদাতা সংস্থা আইপ্যাক নিয়ে মন্তব্য করার পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে কারণ দর্শানোর নোটিস পাওয়ার আগে নেতৃত্বের ‘বার্তা’ পেয়ে নিজেই ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন কামারহাটির তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্র। বৃহস্পতিবারের সভায় সেই আইপ্যাক নিয়েও দলকে বার্তা দিয়েছেন নেত্রী মমতা। তৃণমূলের অনেক প্রবীণ নেতাই আইপ্যাকের ভূমিকায় ‘বিরক্ত’। সম্প্রতি সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও ওই পরামর্শদাতা সংস্থার বিরুদ্ধে অসততার অভিযোগ তুলেছিলেন। কিন্তু মমতা বলে দিয়েছেন, আইপ্যাক সম্পর্কে কোনও ‘উল্টোপাল্টা’ কথা বলা যাবে না। তাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে।
ত্রিকোণ প্রেমের জের! নিজের জীবন শেষ করে রাজামৌলির দিকে আঙুল তুললেন তাঁর ‘বন্ধু’
সার্বিক ভাবে সংগঠনকে ‘কাজের’ বার্তা দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের আমরা পুরস্কৃত করব। কিন্তু যাঁরা শুধু বিবৃতি দেবেন, সমালোচনা করবেন, তাঁদের প্রতি আমার কোনও মায়াদয়া নেই।’’ উল্লেখ্য, অভিষেকও ‘আলটপকা’ মন্তব্য নিয়ে দলকে সতর্ক করতে চেয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘অনেকে ভেসে থাকার জন্য দলের শৃঙ্খলা না-মেনে নানা কথা বলছেন। এগুলো করবেন না। কেউ কেউ ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে দলকে ছোট করছেন।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘অবশ্য এগুলো হলে চিহ্নিত করতে সুবিধা হয়। আমিই মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারীদের চিহ্নিত করেছিলাম।’’
গত ২১ জুলাইয়ের সভার পর থেকেই তৃণমূলে রদবদলের জল্পনা রয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে রদবদল সংক্রান্ত প্রস্তাব দলনেত্রী মমতার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন অভিষেক। কিন্তু তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। অনেকে মনে করেছিলেন, নেতাজি ইন্ডোরের সভা থেকেই ওই রদবদলের কথা ঘোষণা করা হবে। কিন্তু তা হয়নি। তবে মমতা বলেছেন, ‘‘জেলা কমিটিগুলি তৈরি করে দেওয়া হবে। যাঁরা ভোটার তালিকার কাজ ভাল করে করবেন, তাঁরা জায়গা পাবেন।’’ মমতা মনে করিয়ে দিয়েছেন, দলের প্রতীকই ‘শেষ কথা’। সেই প্রতীক না থাকলে যে কেউই মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদ, কাউন্সিলর হতে পারতেন না, তা-ও দ্বর্থ্যহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘অনেকে বলছেন, আমি তৃণমূল বুঝি না। জোড়াফুল বুঝি না। আমি অমুক দাদার লোক। ও সব হবে না। প্রতীকটাই আসল!’’
প্রায় ছ’মাস পরে মমতা ও অভিষেক এক মঞ্চে, ‘দূরত্ব’ কমল না বাড়ল? জল্পনায় মশগুল তৃণমূলের অন্দর
একটা সময় ছিল বীরভূমের সংগঠনকে অনুব্রত মণ্ডলের ‘চোখ’ দিয়ে দেখতেন মমতা। সেখানে বিরোধী গোষ্ঠীকে খানিকটা উপেক্ষাই করা হত। কিন্তু অনুব্রত জেলে যাওয়ার পরে বিরোধী গোষ্ঠীর কাজল শেখদের রেখেই কোর কমিটি গড়ে দিয়েছিলেন নেত্রী। সেই কমিটির নেতৃত্বেই লোকসভা ভোটে বীরভূমের দু’টি আসন ধরে রেখেছে তৃণমূল। জেল থেকে ফেরার পর জেলা সভাপতি পদে আসীন হয়েছেন অনুব্রত। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে তাঁর উদ্দেশে মঞ্চ থেকে মমতা বলেছেন, ‘‘বীরভূমে কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। কাজলকে কনফিডেন্সে নিয়েই কাজ করতে হবে। কোর কমিটিই জেলার কাজ পরিচালনা করবে।’’ অর্থাৎ বীরভূমের সংগঠনে যে অনুব্রতের ‘একাধিপত্য’ নেই, তা ভরা হাটের মাঝে বুঝিয়ে দিয়েছেন দলের নেত্রী। পাশাপাশিই, কাজলকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার নির্দেশের মধ্য দিয়ে অনুব্রতকেই ঠারেঠোরে বার্তা দিয়েছেন এই মর্মে যে, তিনি যেন একাধিপত্য কায়েম করার চেষ্টা না করেন।
সর্বস্তরের কর্মীদের উদ্দেশেও শৃঙ্খলা মেনেই সংগঠন করার বার্তা দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। মমতার কথায়, ‘‘আমি এমন কর্মী চাই, যে কিছু চাইবে না। মাথায় রাখবেন, আপনি দিনে কী করছেন, আর রাতে কী করছেন, তা মানুষ দেখছে।’’

রিপোর্টারের নাম 

























