সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র হচ্ছেন মামদানি

নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে বড় চমক দিয়েছেন ডেমোক্রেটিক দলের জোহরান মামদানি (৩৩)।গতকাল বুধবার রাতে প্রাথমিক ভোটে সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমোকে হারিয়ে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন এই স্বঘোষিত সমাজতান্ত্রিক।

এখনো ভোটের চূড়ান্ত ফল ঘোষণা হয়নি, তবে মামদানি বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় কুয়োমো রাতেই হার মেনে নেন। নির্বাচিত হলে মামদানি হবেন নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র।

মামদানির জয়কে ডেমোক্রেটিক দলের মধ্যপন্থি নেতাদের জন্য এক বড় বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে—যারা প্রভাবশালী কুয়োমোকে সমর্থন করেছিলেন। কারণ, সারা দেশে ট্রাম্পের কট্টর ডানপন্থার মোকাবিলায় কোন পথ ধরে এগোবে, তা ঠিক করতে গিয়েই এখন দিশেহারা দলটি।

উগান্ডায় জন্ম নেওয়া এই স্টেট অ্যাসেম্বলিম্যান শুরুতে কুয়োমোর চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন জনমত জরিপে। তবে, শেষ দিকে নিউইয়র্কের মতো ব্যয়বহুল শহরে ভাড়া কমানো ও বিনামূল্যে ডে-কেয়ারসহ নানা জনমুখী বার্তা দিয়ে তিনি ব্যাপক সমর্থন পান।

নিজের সাবেক শহর নিউইয়র্কের প্রাথমিক নির্বাচনের ফল নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মামদানিকে আক্রমণ করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘সে হলো শতভাগ কমিউনিস্ট পাগল।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘তাকে বেছে নিয়ে ডেমোক্র্যাটরা সীমা অতিক্রম করেছে।’

বিজয় ভাষণে সমর্থকদের উদ্দেশে মামদানি বলেছেন, ‘আজ রাতে আমরা ইতিহাস গড়েছি।’

বুধবার মামদানি বলেন, তার এই চমকপ্রদ জয় এবং পুরো নির্বাচনী প্রচারণা ভবিষ্যতে ডেমোক্রেটদের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।

তিনি পাবলিক রেডিও ডব্লিউএনএনওয়াইকে বলেন, ‘অনেকে বলে ডেমোক্রেটিক পার্টি নাকি খুব বেশি বাম দিকে সরে গেছে। আসলে হয়েছে উল্টো। অনেক দিন ধরে শ্রমজীবী মানুষগুলো পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছে, আর পার্টিও তাদের হাত ছেড়ে দিয়েছে।’

৬৭ বছর বয়সী রাজনীতিবিদ কুয়োমো, যিনি যৌন হয়রানির কেলেঙ্কারির পর সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন, পরাজয় স্বীকার করে প্রতিদ্বন্দ্বী মামদানিকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

নগর প্রশাসনের হিসাবে ৯৫ শতাংশ ব্যালট গণনা শেষে মামদানি পেয়েছেন ৪৩ শতাংশ ভোট। অপরদিকে, কুয়োমোর প্রাপ্ত ভোট প্রায় ৩৬ শতাংশ। তাতে তার ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

তবে, নিউইয়র্ক সিটির এই নির্বাচনে ‘র‌্যাংকড-চয়েস ভোটিং’ পদ্ধতি চালু আছে, যেখানে ভোটাররা পছন্দ অনুযায়ী পাঁচজন প্রার্থীকে নির্বাচন করতে পারেন।

এই পদ্ধতিতে, প্রার্থীরা সরাসরি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে, নির্বাচন কর্মকর্তারা সবচেয়ে কম ভোট পাওয়া প্রার্থীদের বাদ দিয়ে পুনরায় ভোট গণনা শুরু করেন, যা সময়সাপেক্ষ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক লিংকন মিচেল বলেছেন, ‘এই ভোট ডেমোক্রেটিক পার্টির ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের গণভোটের মতোই।’

সাবেক গভর্নর এবং গভর্নরের ছেলে হওয়ায় কুয়োমোর ছিল বিপুল অর্থ ও সর্বজনীন পরিচিতি। কিন্তু যৌন হয়রানির অভিযোগ ও কোভিড পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থতার দায়ে তিনি চার বছর আগে পদত্যাগ করেন। এসব কেলেঙ্কারির ভার বইতে হয়েছে এই প্রচারণায়ও।

তার বিপরীতে মামদানির উত্থান অভাবনীয়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিবাসী পরিবারের সন্তান মামদানি, ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকার সমর্থনে লড়েছেন—যা একটি ছোট ও বামপন্থী রাজনৈতিক ধারা। অনেক ডেমোক্রেট নেতা মনে করেন, এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা দল থেকে বাদ দেওয়া উচিত।

তিনি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলেন এবং ইসরাইলকে ‘গণহত্যাকারী’ বলায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের নজরে রয়েছেন।

মামদানির সমর্থকদের মধ্যে রয়েছেন ট্রাম্পের দু’জন বড় বিরোধী। কট্টর বামপন্থী সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এবং প্রগতিশীল কংগ্রেসওম্যান আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কোর্টেজ।

ওকাসিও কোর্টেজ ‘এক্স’-এর এক পোস্টে লিখেছেন, ‘ধনীরা আর লবিস্টরা কোটি কোটি টাকা ঢেলেছে তোমার বিরুদ্ধে, তবু তুমিই জয়ী হয়েছো।’

বর্তমানে নিউইয়র্কের কুইন্স এলাকার স্টেট অ্যাসেম্বলিম্যান মামদানির প্রধান পরিকল্পনায় আছে নিউইয়র্কে ভাড়া বাড়ানো বন্ধ করা, বাস ভাড়া ফ্রি করা ও সবার জন্য শিশুসেবা দেওয়া।

যে শহরে তিন বেডরুমের একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া ৬ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়, সেখানে মামদানির বার্তা সাধারণ ভোটারের হৃদয় ছুঁয়েছে।

৪৮ বছর বয়সী ভোটার ইমন হারকিন বলেন, ‘আমার জন্য সবচেয়ে সমস্যা হলো খরচ। তিনি আরও বলেন, ‘নিউইয়র্কে সবার জন্য বাসা ভাড়া যেন সাশ্রয়ী হয়, সেটাই এখন আসল বিষয়।’

নভেম্বরে চূড়ান্ত মেয়র নির্বাচনে মামদানির লড়াই হবে আরও কয়েকজন প্রার্থীর সঙ্গে, যার মধ্যে রয়েছেন বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস। যদিও তিনি ডেমোক্রেট, তবু এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সর্বাধিক পঠিত

নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র হচ্ছেন মামদানি

প্রকাশিত সময় : ০৭:০৩:০৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫

নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে বড় চমক দিয়েছেন ডেমোক্রেটিক দলের জোহরান মামদানি (৩৩)।গতকাল বুধবার রাতে প্রাথমিক ভোটে সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমোকে হারিয়ে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন এই স্বঘোষিত সমাজতান্ত্রিক।

এখনো ভোটের চূড়ান্ত ফল ঘোষণা হয়নি, তবে মামদানি বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় কুয়োমো রাতেই হার মেনে নেন। নির্বাচিত হলে মামদানি হবেন নিউইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র।

মামদানির জয়কে ডেমোক্রেটিক দলের মধ্যপন্থি নেতাদের জন্য এক বড় বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে—যারা প্রভাবশালী কুয়োমোকে সমর্থন করেছিলেন। কারণ, সারা দেশে ট্রাম্পের কট্টর ডানপন্থার মোকাবিলায় কোন পথ ধরে এগোবে, তা ঠিক করতে গিয়েই এখন দিশেহারা দলটি।

উগান্ডায় জন্ম নেওয়া এই স্টেট অ্যাসেম্বলিম্যান শুরুতে কুয়োমোর চেয়ে পিছিয়ে ছিলেন জনমত জরিপে। তবে, শেষ দিকে নিউইয়র্কের মতো ব্যয়বহুল শহরে ভাড়া কমানো ও বিনামূল্যে ডে-কেয়ারসহ নানা জনমুখী বার্তা দিয়ে তিনি ব্যাপক সমর্থন পান।

নিজের সাবেক শহর নিউইয়র্কের প্রাথমিক নির্বাচনের ফল নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মামদানিকে আক্রমণ করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘সে হলো শতভাগ কমিউনিস্ট পাগল।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘তাকে বেছে নিয়ে ডেমোক্র্যাটরা সীমা অতিক্রম করেছে।’

বিজয় ভাষণে সমর্থকদের উদ্দেশে মামদানি বলেছেন, ‘আজ রাতে আমরা ইতিহাস গড়েছি।’

বুধবার মামদানি বলেন, তার এই চমকপ্রদ জয় এবং পুরো নির্বাচনী প্রচারণা ভবিষ্যতে ডেমোক্রেটদের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।

তিনি পাবলিক রেডিও ডব্লিউএনএনওয়াইকে বলেন, ‘অনেকে বলে ডেমোক্রেটিক পার্টি নাকি খুব বেশি বাম দিকে সরে গেছে। আসলে হয়েছে উল্টো। অনেক দিন ধরে শ্রমজীবী মানুষগুলো পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছে, আর পার্টিও তাদের হাত ছেড়ে দিয়েছে।’

৬৭ বছর বয়সী রাজনীতিবিদ কুয়োমো, যিনি যৌন হয়রানির কেলেঙ্কারির পর সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন, পরাজয় স্বীকার করে প্রতিদ্বন্দ্বী মামদানিকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

নগর প্রশাসনের হিসাবে ৯৫ শতাংশ ব্যালট গণনা শেষে মামদানি পেয়েছেন ৪৩ শতাংশ ভোট। অপরদিকে, কুয়োমোর প্রাপ্ত ভোট প্রায় ৩৬ শতাংশ। তাতে তার ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

তবে, নিউইয়র্ক সিটির এই নির্বাচনে ‘র‌্যাংকড-চয়েস ভোটিং’ পদ্ধতি চালু আছে, যেখানে ভোটাররা পছন্দ অনুযায়ী পাঁচজন প্রার্থীকে নির্বাচন করতে পারেন।

এই পদ্ধতিতে, প্রার্থীরা সরাসরি ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে, নির্বাচন কর্মকর্তারা সবচেয়ে কম ভোট পাওয়া প্রার্থীদের বাদ দিয়ে পুনরায় ভোট গণনা শুরু করেন, যা সময়সাপেক্ষ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক লিংকন মিচেল বলেছেন, ‘এই ভোট ডেমোক্রেটিক পার্টির ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের গণভোটের মতোই।’

সাবেক গভর্নর এবং গভর্নরের ছেলে হওয়ায় কুয়োমোর ছিল বিপুল অর্থ ও সর্বজনীন পরিচিতি। কিন্তু যৌন হয়রানির অভিযোগ ও কোভিড পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থতার দায়ে তিনি চার বছর আগে পদত্যাগ করেন। এসব কেলেঙ্কারির ভার বইতে হয়েছে এই প্রচারণায়ও।

তার বিপরীতে মামদানির উত্থান অভাবনীয়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিবাসী পরিবারের সন্তান মামদানি, ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকার সমর্থনে লড়েছেন—যা একটি ছোট ও বামপন্থী রাজনৈতিক ধারা। অনেক ডেমোক্রেট নেতা মনে করেন, এই ধরনের চিন্তা-ভাবনা দল থেকে বাদ দেওয়া উচিত।

তিনি ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলেন এবং ইসরাইলকে ‘গণহত্যাকারী’ বলায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের নজরে রয়েছেন।

মামদানির সমর্থকদের মধ্যে রয়েছেন ট্রাম্পের দু’জন বড় বিরোধী। কট্টর বামপন্থী সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এবং প্রগতিশীল কংগ্রেসওম্যান আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কোর্টেজ।

ওকাসিও কোর্টেজ ‘এক্স’-এর এক পোস্টে লিখেছেন, ‘ধনীরা আর লবিস্টরা কোটি কোটি টাকা ঢেলেছে তোমার বিরুদ্ধে, তবু তুমিই জয়ী হয়েছো।’

বর্তমানে নিউইয়র্কের কুইন্স এলাকার স্টেট অ্যাসেম্বলিম্যান মামদানির প্রধান পরিকল্পনায় আছে নিউইয়র্কে ভাড়া বাড়ানো বন্ধ করা, বাস ভাড়া ফ্রি করা ও সবার জন্য শিশুসেবা দেওয়া।

যে শহরে তিন বেডরুমের একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া ৬ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়, সেখানে মামদানির বার্তা সাধারণ ভোটারের হৃদয় ছুঁয়েছে।

৪৮ বছর বয়সী ভোটার ইমন হারকিন বলেন, ‘আমার জন্য সবচেয়ে সমস্যা হলো খরচ। তিনি আরও বলেন, ‘নিউইয়র্কে সবার জন্য বাসা ভাড়া যেন সাশ্রয়ী হয়, সেটাই এখন আসল বিষয়।’

নভেম্বরে চূড়ান্ত মেয়র নির্বাচনে মামদানির লড়াই হবে আরও কয়েকজন প্রার্থীর সঙ্গে, যার মধ্যে রয়েছেন বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামস। যদিও তিনি ডেমোক্রেট, তবু এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছেন।