সোমবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ৭ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গাজা যুদ্ধে প্রশ্নের মুখে বিবিসির সম্পাদকীয় নীতি

গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ সম্পর্কে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী সরকারি গণমাধ্যম বিবিসি। আর এই কাজ করতে গিয়ে একুশ শতাব্দীর অন্যতম নিষ্ঠুর সামরিক অভিযানকে বারবার আড়াল করেছে, তুচ্ছ করেছে এবং নির্বিষভাবে উপস্থাপন করেছে সংবাদমাধ্যমটি।

সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং (সিএফএমএম) থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিবিসির সংবাদ প্রতিবেদনগুলোতে এক ধ্বংসাত্মক ধারার কথা তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে ইসরায়েলি কণ্ঠকে নিরন্তর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিপরীতে ফিলিস্তিনের এই বিপর্যয়ের পেছনে দখলদারিত্ব, অবরোধ ও বর্ণবাদী ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটকে তুচ্ছভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

তাদের  ভুল ছোটখাটো সম্পাদনাগত কোনো ত্রুটি নয়।

এটি একটি পদ্ধতিগত ব্যর্থতা, যেখানে ফিলিস্তিনিদের পুরোপুরি মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। বিবিসির মতো এমন একটি সম্প্রচারমাধ্যম তার নিরপেক্ষতার দায়িত্ব পালন না করে গভীরভাবে রাজনৈতিক ও একতরফা বয়ানকে বেছে নিয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েল যখন গাজায় আক্রমণ শুরু করে তখন থেকেই বিবিসি এই যুদ্ধকে দশকব্যাপী উপনিবেশবাদ, অবরোধ ও উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা হিসেবে উপস্থাপন না করে বরং দুটি পক্ষের মধ্যে একটি সমান সংঘর্ষ হিসেবে চিত্রিত করেছে।

বিবিসির প্রতিবেদনগুলোতে‘দখলদারিত্ব’ শব্দটি উহ্য রাখা সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ব্যবহৃত ‘সেটেলমেন্ট’, ‘ব্লকেড’ ও ‘বর্ণবাদের’ মতো শব্দগুলো প্রায় সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত বিবিসিতে। এসব শব্দের পরিবর্তে যুদ্ধটিকে একটি প্রতিঘাতমূলক লড়াই হিসেবে দেখানো হয়েছে বিবিসিতে, যেখানে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে কোনো ঐতিহাসিক বা আইনগত প্রেক্ষাপট ছাড়াই উপস্থাপন করা হয়েছে।

বাস্তবতার বিভৎস বিকৃতি
মিডিল ইস্ট আই-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যতম উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে গাজায় আক্রামণ করা হয়েছে। ২০ লাখ মানুষের ওপর চালানো এমন সহিংসতাকে মুছে ফেলা হয়েছে শূন্যার্থক কৌশলী শব্দচয়ন ও নিষ্ক্রিয় বাক্য গঠনের মাধ্যমে। বাস্তবতার বিভৎস বিকৃতি করা হয়েছে আলাদা আলাদা প্রতিবেদন তৈরি করে।

গাজায় ৫৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছে, যার বেশিরভাগই নারী ও শিশু। সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিংয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিবিসির প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনিদের সাধারণত বলা হয়েছে ‘মারা গেছে’ বা ‘বিমান হামলায় নিহত হয়েছে’।  হামলাগুলো কারা চালিয়েছে, সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই।

অন্যদিকে, ইসরায়েলি ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় ব্যবহৃত হয়েছে আরো আবেগপূর্ণ শব্দ যেমন ‘নিহত’, ‘হত্যাযজ্ঞ’ ও ‘জবাই করে মারা হয়েছে’।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধসম্পর্কিত বিবিসির ৩৫ হাজারের বেশি কনটেন্ট বিশ্লেষণ করেছে সিএফএমএম।

বিবিসি ‘হত্যাযজ্ঞ’ শব্দটি ইসরায়েলিদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের তুলনায় ১৮ গুণ বেশি ব্যবহার করেছে। যদিও বহু সংখ্যক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, তবুও উভয় পক্ষের জন্য প্রায় সমান সংখ্যক ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রচার করা হয়েছে।

এটি কোনো নিরপেক্ষ সম্পাদনা নীতির সিদ্ধান্ত নয়; এটি ফিলিস্তিনি প্রাণের অবমূল্যায়ন। এখানেই শেষ নয়, বিবিসির অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ফিলিস্তিনি অতিথিদের নিয়মিতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, বারবার বাধা দেওয়া হয়েছে এবং হামাসকে নিন্দা জানাতে চাপ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলি মুখপাত্ররা, যাদের অনেকেই টিভিতে যুদ্ধাপরাধকে সমর্থন করেছেন, তাদের প্রতি দেখানো হয়েছে শ্রদ্ধাশীল আচরণ।

একজন ইসরায়েলি অতিথিকেও হাসপাতাল, শরণার্থীশিবির বা স্কুলে ইচ্ছাকৃত বোমা হামলার নিন্দা জানাতে বলা হয়নি। এই অসমতা জিম্মি ও বন্দিদের প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে ফুঠে উঠেছে।

আবেগঘন সাক্ষাৎকার, ধারাবাহিক আপডেট এবং সংবেদনশীল মানবিক বিবরণসহ ইসরায়েলি জিম্মিদের নিয়ে প্রচুর সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। অন্যদিকে, অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই বছরের পর বছর ইসরায়েলের কারাগারে যারা বন্দি রয়েছেন, বিবিসি সংবাদ প্রতিবেদনে তারা প্রায় অদৃশ্য।

বন্দি বিনিময়ের সময়েও বিবিসির কভারেজ প্রায় সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলি প্রত্যাবর্তনকারীদের ঘিরে। ফিলিস্তিনি বন্দিরা কারা ছিলেন? তারা কতদিন ধরে বন্দি ছিলেন? তাদের ওপর কী নির্যাতন চালানো হয়েছে, যথাযথ বিচার প্রক্রিয়া থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে কি না? এই প্রশ্নগুলো প্রায় বিবিসি তোলে না এবং উত্তরও পাওয়া যায় না।

এই ধরনের সম্পাদনানীতির অন্ধত্ব কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি এমন এক গভীর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি থেকে আসে, যা ফিলিস্তিনিদের বৈধ অভিযোগ, আকাঙ্ক্ষা ও অধিকার থাকা মানুষ হিসেবে দেখতে অস্বীকার করা। ফিলিস্তিনিরা যেন কেবল ভুক্তভোগী বা সন্ত্রাসী হিসেবেই কথা বলে, কখনোই দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারী মানবিক সত্তা হিসেবে নয়।

বিবিসির ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই মনোভাব সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। প্রতিবেদনে একশ’র বেশি এমন উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে উপস্থাপকরা অতিথিদের বাধা দিয়েছেন বা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, যখন তারা গাজায় ইসরায়েলের কার্যকলাপকে ‘গণহত্যা’ বলে উল্লেখ করেছেন।

নিরন্তর বিশ্বাসঘাতকতা
ইউক্রেনের প্রসঙ্গে বিবিসি নির্দ্বিধায় এমন ভাষা ব্যবহার করে, যেখানে রাশিয়ার আগ্রাসন বর্ণনার সময় ‘যুদ্ধাপরাধ’ এর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। কিন্তু ইসরায়েলের ক্ষেত্রে বিবিসি ভাষাগত জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে, বলতেই পারে না যা কোটি কোটি মানুষ খালি চোখে দেখতে পাচ্ছে গাজায় একটি পরিকল্পিত ও অবিরাম ধ্বংসযজ্ঞের অভিযান চলছে। এটা কোনো ভারসাম্য নয়। এটা হচ্ছে সেন্সরশিপ, যা ক্ষমতাবানদের আড়াল করে আর নির্যাতিতদের কণ্ঠরোধ করে।

বিশ্বাসঘাতকতা সবচেয়ে গভীরভাবে প্রকাশ পায় সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেই। গাজায় যুদ্ধ চলাকালে এখন পর্যন্ত ২২৫ জনেরও বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। তবু বিবিসি মাত্র ছয় শতাংশ এমন মৃত্যুর খবর প্রচার করেছে।

অনেকে ক্যামেরা হাতে নিয়েই প্রাণ দিয়েছেন। তাদের মৃত্যু যেকোনো সংবাদ সংস্থার জন্য গভীর আত্মবিশ্লেষণের প্রধান বিষয় হওয়া উচিত। কিন্তু তাদের মৃত্যুকে পটভূমির শব্দের মতোই বর্ণনা করা হয়েছে।

এর তুলনা করা যেতে পারে ইউক্রেনের সঙ্গে; যেখানে সাংবাদিকদের মৃত্যুর ৬২ শতাংশই বিবিসিতে প্রচারিত হয়েছে। এই বৈষম্য অনেক কিছু বলে দেয়। গাজায়, এমনকি সাংবাদিকদের মৃত্যু- যাদের মাধ্যমে আমরা বিশ্ব দেখি, তাদেরকেও বিবিসি পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি।

গত বছর ১০০ জনেরও বেশি বিবিসিকর্মী একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেন, যেখানে তারা অভিযোগ করেন, গাজা নিয়ে বিবিসি ন্যায়সঙ্গতভাবে সংবাদ প্রচার করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

সম্প্রতি বিবিসি তাদের গাজা-সংক্রান্ত সংবাদ প্রতিবেদন নিয়ে সমালোচনার জবাবে বলেছে, তারা “স্বচ্ছ” থাকে এবং যে সব সীমাবদ্ধতার মধ্যে তাদের সাংবাদিকদের কাজ করতে হয়, বিশেষ করে সংঘাতময় অঞ্চলগুলোতে, সেগুলো তারা ‘দর্শকদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা’ করে।

তারা আরো বলেছে, গাজার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত ও বিপজ্জনক এলাকায় ‘মাটিতে থাকা’ কঠিন। কারণ, সেখানে সাংবাদিকদের চলাচল, তথ্য যাচাই এবং নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকে। এই কারণে কখনো কখনো প্রতিবেদন সম্পূর্ণ নয় বা নির্দিষ্ট কিছু তথ্য পরে সংশোধন করতে হয়।

বিবিসি কর্মীদের তুলনা করা উদ্বেগগুলো সিএফএমএমের প্রতিবেদনেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

বিবিসি নিজেকে বিশ্বমানের সাংবাদিকতার মানদণ্ড হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু যখন তার সংবাদ কভারেজ বারবার ক্ষমতাবানদের কণ্ঠকে জোরদার করে, আর নিশ্চিহ্ন হতে বসা মানুষদের কণ্ঠরোধ করে, তখন তা নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক থাকে না।

অবিচারের মুখে নীরবতা কখনোই পক্ষপাতহীনতা নয়। জনগণ এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করে। যেমন শহীদ ফিলিস্তিনিরাও; আর যারা এখনো বেঁচে আছেন তারাও।

[নোট: ফয়সাল হানিফ একজন মিডিয়া বিশ্লেষক। তিনি সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিংয়ে কাজ করেন। এর আগে তিনি দ্য টাইমস এবং বিবিসি প্রতিবেদক ও গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। তার বিশেষ প্রতিবেদনটি সম্প্রতি দ্যা মিডিল ইস্ট আই প্রকাশ করেছে। অনুবাদ করেছেন তানজিনা ইভা

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সর্বাধিক পঠিত

গাজা যুদ্ধে প্রশ্নের মুখে বিবিসির সম্পাদকীয় নীতি

প্রকাশিত সময় : ১১:৩৮:৩৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৫ জুলাই ২০২৫

গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ সম্পর্কে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী সরকারি গণমাধ্যম বিবিসি। আর এই কাজ করতে গিয়ে একুশ শতাব্দীর অন্যতম নিষ্ঠুর সামরিক অভিযানকে বারবার আড়াল করেছে, তুচ্ছ করেছে এবং নির্বিষভাবে উপস্থাপন করেছে সংবাদমাধ্যমটি।

সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং (সিএফএমএম) থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিবিসির সংবাদ প্রতিবেদনগুলোতে এক ধ্বংসাত্মক ধারার কথা তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে ইসরায়েলি কণ্ঠকে নিরন্তর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বিপরীতে ফিলিস্তিনের এই বিপর্যয়ের পেছনে দখলদারিত্ব, অবরোধ ও বর্ণবাদী ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটকে তুচ্ছভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

তাদের  ভুল ছোটখাটো সম্পাদনাগত কোনো ত্রুটি নয়।

এটি একটি পদ্ধতিগত ব্যর্থতা, যেখানে ফিলিস্তিনিদের পুরোপুরি মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। বিবিসির মতো এমন একটি সম্প্রচারমাধ্যম তার নিরপেক্ষতার দায়িত্ব পালন না করে গভীরভাবে রাজনৈতিক ও একতরফা বয়ানকে বেছে নিয়েছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েল যখন গাজায় আক্রমণ শুরু করে তখন থেকেই বিবিসি এই যুদ্ধকে দশকব্যাপী উপনিবেশবাদ, অবরোধ ও উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা হিসেবে উপস্থাপন না করে বরং দুটি পক্ষের মধ্যে একটি সমান সংঘর্ষ হিসেবে চিত্রিত করেছে।

বিবিসির প্রতিবেদনগুলোতে‘দখলদারিত্ব’ শব্দটি উহ্য রাখা সাধারণ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ব্যবহৃত ‘সেটেলমেন্ট’, ‘ব্লকেড’ ও ‘বর্ণবাদের’ মতো শব্দগুলো প্রায় সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত বিবিসিতে। এসব শব্দের পরিবর্তে যুদ্ধটিকে একটি প্রতিঘাতমূলক লড়াই হিসেবে দেখানো হয়েছে বিবিসিতে, যেখানে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকে কোনো ঐতিহাসিক বা আইনগত প্রেক্ষাপট ছাড়াই উপস্থাপন করা হয়েছে।

বাস্তবতার বিভৎস বিকৃতি
মিডিল ইস্ট আই-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যতম উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে গাজায় আক্রামণ করা হয়েছে। ২০ লাখ মানুষের ওপর চালানো এমন সহিংসতাকে মুছে ফেলা হয়েছে শূন্যার্থক কৌশলী শব্দচয়ন ও নিষ্ক্রিয় বাক্য গঠনের মাধ্যমে। বাস্তবতার বিভৎস বিকৃতি করা হয়েছে আলাদা আলাদা প্রতিবেদন তৈরি করে।

গাজায় ৫৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি মারা গেছে, যার বেশিরভাগই নারী ও শিশু। সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিংয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিবিসির প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনিদের সাধারণত বলা হয়েছে ‘মারা গেছে’ বা ‘বিমান হামলায় নিহত হয়েছে’।  হামলাগুলো কারা চালিয়েছে, সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই।

অন্যদিকে, ইসরায়েলি ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় ব্যবহৃত হয়েছে আরো আবেগপূর্ণ শব্দ যেমন ‘নিহত’, ‘হত্যাযজ্ঞ’ ও ‘জবাই করে মারা হয়েছে’।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধসম্পর্কিত বিবিসির ৩৫ হাজারের বেশি কনটেন্ট বিশ্লেষণ করেছে সিএফএমএম।

বিবিসি ‘হত্যাযজ্ঞ’ শব্দটি ইসরায়েলিদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের তুলনায় ১৮ গুণ বেশি ব্যবহার করেছে। যদিও বহু সংখ্যক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, তবুও উভয় পক্ষের জন্য প্রায় সমান সংখ্যক ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রচার করা হয়েছে।

এটি কোনো নিরপেক্ষ সম্পাদনা নীতির সিদ্ধান্ত নয়; এটি ফিলিস্তিনি প্রাণের অবমূল্যায়ন। এখানেই শেষ নয়, বিবিসির অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ফিলিস্তিনি অতিথিদের নিয়মিতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, বারবার বাধা দেওয়া হয়েছে এবং হামাসকে নিন্দা জানাতে চাপ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলি মুখপাত্ররা, যাদের অনেকেই টিভিতে যুদ্ধাপরাধকে সমর্থন করেছেন, তাদের প্রতি দেখানো হয়েছে শ্রদ্ধাশীল আচরণ।

একজন ইসরায়েলি অতিথিকেও হাসপাতাল, শরণার্থীশিবির বা স্কুলে ইচ্ছাকৃত বোমা হামলার নিন্দা জানাতে বলা হয়নি। এই অসমতা জিম্মি ও বন্দিদের প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে ফুঠে উঠেছে।

আবেগঘন সাক্ষাৎকার, ধারাবাহিক আপডেট এবং সংবেদনশীল মানবিক বিবরণসহ ইসরায়েলি জিম্মিদের নিয়ে প্রচুর সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। অন্যদিকে, অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই বছরের পর বছর ইসরায়েলের কারাগারে যারা বন্দি রয়েছেন, বিবিসি সংবাদ প্রতিবেদনে তারা প্রায় অদৃশ্য।

বন্দি বিনিময়ের সময়েও বিবিসির কভারেজ প্রায় সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলি প্রত্যাবর্তনকারীদের ঘিরে। ফিলিস্তিনি বন্দিরা কারা ছিলেন? তারা কতদিন ধরে বন্দি ছিলেন? তাদের ওপর কী নির্যাতন চালানো হয়েছে, যথাযথ বিচার প্রক্রিয়া থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে কি না? এই প্রশ্নগুলো প্রায় বিবিসি তোলে না এবং উত্তরও পাওয়া যায় না।

এই ধরনের সম্পাদনানীতির অন্ধত্ব কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি এমন এক গভীর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি থেকে আসে, যা ফিলিস্তিনিদের বৈধ অভিযোগ, আকাঙ্ক্ষা ও অধিকার থাকা মানুষ হিসেবে দেখতে অস্বীকার করা। ফিলিস্তিনিরা যেন কেবল ভুক্তভোগী বা সন্ত্রাসী হিসেবেই কথা বলে, কখনোই দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারী মানবিক সত্তা হিসেবে নয়।

বিবিসির ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই মনোভাব সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। প্রতিবেদনে একশ’র বেশি এমন উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে উপস্থাপকরা অতিথিদের বাধা দিয়েছেন বা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, যখন তারা গাজায় ইসরায়েলের কার্যকলাপকে ‘গণহত্যা’ বলে উল্লেখ করেছেন।

নিরন্তর বিশ্বাসঘাতকতা
ইউক্রেনের প্রসঙ্গে বিবিসি নির্দ্বিধায় এমন ভাষা ব্যবহার করে, যেখানে রাশিয়ার আগ্রাসন বর্ণনার সময় ‘যুদ্ধাপরাধ’ এর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। কিন্তু ইসরায়েলের ক্ষেত্রে বিবিসি ভাষাগত জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে, বলতেই পারে না যা কোটি কোটি মানুষ খালি চোখে দেখতে পাচ্ছে গাজায় একটি পরিকল্পিত ও অবিরাম ধ্বংসযজ্ঞের অভিযান চলছে। এটা কোনো ভারসাম্য নয়। এটা হচ্ছে সেন্সরশিপ, যা ক্ষমতাবানদের আড়াল করে আর নির্যাতিতদের কণ্ঠরোধ করে।

বিশ্বাসঘাতকতা সবচেয়ে গভীরভাবে প্রকাশ পায় সাংবাদিকদের ক্ষেত্রেই। গাজায় যুদ্ধ চলাকালে এখন পর্যন্ত ২২৫ জনেরও বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। তবু বিবিসি মাত্র ছয় শতাংশ এমন মৃত্যুর খবর প্রচার করেছে।

অনেকে ক্যামেরা হাতে নিয়েই প্রাণ দিয়েছেন। তাদের মৃত্যু যেকোনো সংবাদ সংস্থার জন্য গভীর আত্মবিশ্লেষণের প্রধান বিষয় হওয়া উচিত। কিন্তু তাদের মৃত্যুকে পটভূমির শব্দের মতোই বর্ণনা করা হয়েছে।

এর তুলনা করা যেতে পারে ইউক্রেনের সঙ্গে; যেখানে সাংবাদিকদের মৃত্যুর ৬২ শতাংশই বিবিসিতে প্রচারিত হয়েছে। এই বৈষম্য অনেক কিছু বলে দেয়। গাজায়, এমনকি সাংবাদিকদের মৃত্যু- যাদের মাধ্যমে আমরা বিশ্ব দেখি, তাদেরকেও বিবিসি পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি।

গত বছর ১০০ জনেরও বেশি বিবিসিকর্মী একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেন, যেখানে তারা অভিযোগ করেন, গাজা নিয়ে বিবিসি ন্যায়সঙ্গতভাবে সংবাদ প্রচার করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

সম্প্রতি বিবিসি তাদের গাজা-সংক্রান্ত সংবাদ প্রতিবেদন নিয়ে সমালোচনার জবাবে বলেছে, তারা “স্বচ্ছ” থাকে এবং যে সব সীমাবদ্ধতার মধ্যে তাদের সাংবাদিকদের কাজ করতে হয়, বিশেষ করে সংঘাতময় অঞ্চলগুলোতে, সেগুলো তারা ‘দর্শকদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা’ করে।

তারা আরো বলেছে, গাজার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত ও বিপজ্জনক এলাকায় ‘মাটিতে থাকা’ কঠিন। কারণ, সেখানে সাংবাদিকদের চলাচল, তথ্য যাচাই এবং নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকে। এই কারণে কখনো কখনো প্রতিবেদন সম্পূর্ণ নয় বা নির্দিষ্ট কিছু তথ্য পরে সংশোধন করতে হয়।

বিবিসি কর্মীদের তুলনা করা উদ্বেগগুলো সিএফএমএমের প্রতিবেদনেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

বিবিসি নিজেকে বিশ্বমানের সাংবাদিকতার মানদণ্ড হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু যখন তার সংবাদ কভারেজ বারবার ক্ষমতাবানদের কণ্ঠকে জোরদার করে, আর নিশ্চিহ্ন হতে বসা মানুষদের কণ্ঠরোধ করে, তখন তা নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক থাকে না।

অবিচারের মুখে নীরবতা কখনোই পক্ষপাতহীনতা নয়। জনগণ এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করে। যেমন শহীদ ফিলিস্তিনিরাও; আর যারা এখনো বেঁচে আছেন তারাও।

[নোট: ফয়সাল হানিফ একজন মিডিয়া বিশ্লেষক। তিনি সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিংয়ে কাজ করেন। এর আগে তিনি দ্য টাইমস এবং বিবিসি প্রতিবেদক ও গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন। তার বিশেষ প্রতিবেদনটি সম্প্রতি দ্যা মিডিল ইস্ট আই প্রকাশ করেছে। অনুবাদ করেছেন তানজিনা ইভা