মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জাজিরায় পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ভাঙন

বর্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত সোমবার থেকে বুধবার (৯ জুলাই) সকাল পর্যন্ত বাঁধটির ১৩০ মিটার নদীতে ধসে পড়েছে।বিলীন হয়েছে বসতবাড়ি ও দোকানসহ অন্তত ২৬টি স্থাপনা।

ভাঙন আতঙ্কে ইতোমধ্যে নদীর পাড় থেকে ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন স্থানীয়দের অনেকেই। তারা জানান, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে হুমকিতে পড়বে রাস্তা, হাটবাজার ও শতাধিক বসতবাড়ি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পদ্মার পাড়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রায় এক হাজার জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হয়েছে।  প্রশাসন বলেছে, পূর্ব সতর্কতায় ঘর সরানো পরিবারগুলোকে দেওয়া হবে সহায়তা।

শরীয়তপুরের জাজিরার মাঝিরঘাটের ইলিয়াস খলিফার ছোট ছেলে মিনাজ। বয়স মাত্র ১০ বছর অথচ তার চোখে এখন ভয়, উৎকণ্ঠা আর দায়িত্ববোধ। ভাঙনে চাচার দোকান পদ্মায় বিলীন হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে কাজ করছিল সে। তার চোখে-মুখে ছিল বিপদ থেকে বাঁচার চেষ্টা।

মিজান রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “গাং ভাঙতাছে অনেক, আমরা বিপদে আছি আমাদের বাঁচান। আমাদের ঘর-দোকান পানিতে চলে যাচ্ছে, আমাদের বাঁচান।” শুধু মিজানের চাচার দোকান নয়, পদ্মার ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে জাজিরার আলম খার কান্দি, উকিল উদ্দিন মুন্সি কান্দি এবং ওছিম উদ্দিন মুন্সি কান্দি গ্রামের অন্তত ৬০০ পরিবারের।

পদ্মার ভাঙন থেকে বাঁচাতে চাচার দোকানের কাঠ খুলে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছে মিজান ও তার বন্ধু

স্থানীয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ২০১০-২০১১ অর্থবছরে পদ্মা সেতু থেকে মাঝিরঘাট হয়ে পূর্ব নাওডোবা আলমখার কান্দি জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ২ কিলোমিটার পদ্মা সেতু প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। এতে ব্যয় হয় ১১০ কোটি টাকা। গত বছরের ৩ নভেম্বর থেকে বাঁধের নাওডোবা ইউনিয়নের মাঝিরঘাট এলাকায় ধস শুরু হয়।

গত ১৬ নভেম্বর বিকেল পর্যন্ত বাঁধটির প্রায় ১০০ মিটার ধসে পড়ে নদীতে। এতে কংক্রিটের সিসি ব্লকগুলো তলিয়ে যায় পানিতে। এছাড়াও এলাকাটির আশপাশে দেখা দেয় ফাটল। পরে বাঁধটির সংস্কারে দায়িত্ব দেওয়া হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। গত বছর ওই বাঁধের যে ১০০ মিটার অংশ বিলীন হয়েছিল সেখানে ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বালু ভর্তি জিওব্যাগ ও সিসিব্লক ফেলার কাজ শুরু হয়।

এদিকে, ঈদের দিন ভোররাতে সংস্কার করা বাঁধের ১০০ মিটার অংশসহ পাশের আরো একটি স্থানে ভাঙন শুরু হয়। একদিনের মধ্যে বাঁধের আড়াইশো মিটার অংশ নদীতে তলিয়ে যায়। এরপরই ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে নতুন করে জিওব্যাগ ডাম্পিং করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। গত সোমবার (৭ জুলাই) বিকেলে নতুন করে ভাঙন দেখা দেয় রক্ষা বাঁধে। মাত্র দুই ঘণ্টার ভাঙনে নদীগর্ভে বিলিন হয় ১৬টি বাড়ি ও ১০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ভাঙন আশঙ্কায় সরিয়ে নেওয়া হয় ১৫টি দোকান।

 

মঙ্গল মাঝির ঘাট বাজারের ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলাম বলেন, “এমন আকস্মিক ভাঙনের কারণে আমরা শ্রমিক পাচ্ছি না। যার যার মালামাল তার তার পরিবারের সদস্যরা সরিয়ে নিচ্ছে। আমরা অনেক বিপদের মধ্যে আছি। আমরা চাই, যেভাবেই হোক নদীর ভাঙন রোধ করা হোক।”

স্থানীয় বাসিন্দা বাদশা শেখ বলেন, “নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে পাড়ের কাছে চলে আসায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত বছর থেকে এই এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। আমরা এলাকাবাসী খুবই আতঙ্কে আছি। আমরা চাই, দ্রুত এই এলাকায় শক্ত একটি বাঁধ নির্মাণ করা হোক।”

বুধবার (৯ জুলাই) সকালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ তারেক হাসান বলেন, “বাঁধের ১৩০ মিটার নদীতে বিলীন হয়েছে। আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ভাঙনের পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ।”

তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে কিছু বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আমরা প্রায় ৯০ জন শ্রমিক নিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও পদ্মার পাড়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রায় এক হাজার জিও ব্যাগ ডাম্পিং করেছি। ভাঙন রোধে দ্রুত সময়ের মধ্যেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।”

জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাবেরী রায় বলেন, “ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে সতর্কতামূলকভাবে বাড়ি সরিয়ে নেওয়া ২৬টি পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকার চেক দেওয়া হয়েছে। যাদের ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে, তাদের মধ্যে দুই বান টিন ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের  পুনর্বাসনের জন্য পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন।”

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে যুবকের রহস্যজনক মৃত্যু, ঝুলন্ত  লাশ উদ্ধার

জাজিরায় পদ্মা সেতু প্রকল্প রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ভাঙন

প্রকাশিত সময় : ১২:০৯:৪৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫

বর্ষা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের রক্ষা বাঁধে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত সোমবার থেকে বুধবার (৯ জুলাই) সকাল পর্যন্ত বাঁধটির ১৩০ মিটার নদীতে ধসে পড়েছে।বিলীন হয়েছে বসতবাড়ি ও দোকানসহ অন্তত ২৬টি স্থাপনা।

ভাঙন আতঙ্কে ইতোমধ্যে নদীর পাড় থেকে ঘর অন্যত্র সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন স্থানীয়দের অনেকেই। তারা জানান, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে হুমকিতে পড়বে রাস্তা, হাটবাজার ও শতাধিক বসতবাড়ি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পদ্মার পাড়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রায় এক হাজার জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হয়েছে।  প্রশাসন বলেছে, পূর্ব সতর্কতায় ঘর সরানো পরিবারগুলোকে দেওয়া হবে সহায়তা।

শরীয়তপুরের জাজিরার মাঝিরঘাটের ইলিয়াস খলিফার ছোট ছেলে মিনাজ। বয়স মাত্র ১০ বছর অথচ তার চোখে এখন ভয়, উৎকণ্ঠা আর দায়িত্ববোধ। ভাঙনে চাচার দোকান পদ্মায় বিলীন হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে কাজ করছিল সে। তার চোখে-মুখে ছিল বিপদ থেকে বাঁচার চেষ্টা।

মিজান রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “গাং ভাঙতাছে অনেক, আমরা বিপদে আছি আমাদের বাঁচান। আমাদের ঘর-দোকান পানিতে চলে যাচ্ছে, আমাদের বাঁচান।” শুধু মিজানের চাচার দোকান নয়, পদ্মার ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে জাজিরার আলম খার কান্দি, উকিল উদ্দিন মুন্সি কান্দি এবং ওছিম উদ্দিন মুন্সি কান্দি গ্রামের অন্তত ৬০০ পরিবারের।

পদ্মার ভাঙন থেকে বাঁচাতে চাচার দোকানের কাঠ খুলে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছে মিজান ও তার বন্ধু

স্থানীয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ২০১০-২০১১ অর্থবছরে পদ্মা সেতু থেকে মাঝিরঘাট হয়ে পূর্ব নাওডোবা আলমখার কান্দি জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ২ কিলোমিটার পদ্মা সেতু প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। এতে ব্যয় হয় ১১০ কোটি টাকা। গত বছরের ৩ নভেম্বর থেকে বাঁধের নাওডোবা ইউনিয়নের মাঝিরঘাট এলাকায় ধস শুরু হয়।

গত ১৬ নভেম্বর বিকেল পর্যন্ত বাঁধটির প্রায় ১০০ মিটার ধসে পড়ে নদীতে। এতে কংক্রিটের সিসি ব্লকগুলো তলিয়ে যায় পানিতে। এছাড়াও এলাকাটির আশপাশে দেখা দেয় ফাটল। পরে বাঁধটির সংস্কারে দায়িত্ব দেওয়া হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। গত বছর ওই বাঁধের যে ১০০ মিটার অংশ বিলীন হয়েছিল সেখানে ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ব্যয়ে বালু ভর্তি জিওব্যাগ ও সিসিব্লক ফেলার কাজ শুরু হয়।

এদিকে, ঈদের দিন ভোররাতে সংস্কার করা বাঁধের ১০০ মিটার অংশসহ পাশের আরো একটি স্থানে ভাঙন শুরু হয়। একদিনের মধ্যে বাঁধের আড়াইশো মিটার অংশ নদীতে তলিয়ে যায়। এরপরই ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে নতুন করে জিওব্যাগ ডাম্পিং করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। গত সোমবার (৭ জুলাই) বিকেলে নতুন করে ভাঙন দেখা দেয় রক্ষা বাঁধে। মাত্র দুই ঘণ্টার ভাঙনে নদীগর্ভে বিলিন হয় ১৬টি বাড়ি ও ১০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ভাঙন আশঙ্কায় সরিয়ে নেওয়া হয় ১৫টি দোকান।

 

মঙ্গল মাঝির ঘাট বাজারের ব্যবসায়ী সাইদুল ইসলাম বলেন, “এমন আকস্মিক ভাঙনের কারণে আমরা শ্রমিক পাচ্ছি না। যার যার মালামাল তার তার পরিবারের সদস্যরা সরিয়ে নিচ্ছে। আমরা অনেক বিপদের মধ্যে আছি। আমরা চাই, যেভাবেই হোক নদীর ভাঙন রোধ করা হোক।”

স্থানীয় বাসিন্দা বাদশা শেখ বলেন, “নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে পাড়ের কাছে চলে আসায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত বছর থেকে এই এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। আমরা এলাকাবাসী খুবই আতঙ্কে আছি। আমরা চাই, দ্রুত এই এলাকায় শক্ত একটি বাঁধ নির্মাণ করা হোক।”

বুধবার (৯ জুলাই) সকালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ তারেক হাসান বলেন, “বাঁধের ১৩০ মিটার নদীতে বিলীন হয়েছে। আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ভাঙনের পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ।”

তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে কিছু বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আমরা প্রায় ৯০ জন শ্রমিক নিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও পদ্মার পাড়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রায় এক হাজার জিও ব্যাগ ডাম্পিং করেছি। ভাঙন রোধে দ্রুত সময়ের মধ্যেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।”

জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাবেরী রায় বলেন, “ভাঙন রোধে জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে সতর্কতামূলকভাবে বাড়ি সরিয়ে নেওয়া ২৬টি পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকার চেক দেওয়া হয়েছে। যাদের ঘর সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে, তাদের মধ্যে দুই বান টিন ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের  পুনর্বাসনের জন্য পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন।”