বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের তেঁতুলিয়া নদী তীরের চরমিঠুয়া গ্রাম। বাইরে থেকে দেখলে সাধারণ চরগ্রাম। কিন্তু এই মাটির নিচেই চাপা ছিল এক বিরাট ইতিহাস। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চর মিঠুয়ার মাটির নিচে নিঃশব্দে শুয়ে ছিল এক বিশাল লৌহদেহ।
বিদেশি বাণিজ্যের সাক্ষী সেই দানবাকৃতি জাপানি জাহাজ অবশেষে ভেসে উঠল আলোয়। কাকতালীয় নয়, বরং এক যুগেরও বেশি সময়ের নিরলস প্রচেষ্টা ও কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেই সম্ভব হয়েছে এই উদ্ধারকাজ।
তেঁতুলিয়ার বুক একদিন ছিল বিদেশি বাণিজ্যের প্রধান রুট। সেই চর মিঠুয়া এখন ইতিহাসের মঞ্চ।
সেখানেই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস আজ আবার মাথা তুলেছে। চরবাসীর অজান্তে তিন দশক ধরে ঘুমিয়ে থাকা জাহাজ এক লহমায় গ্রামকে পরিণত করেছে কৌতূহলী মানুষের মিলনমেলায়। প্রতিদিন হাজারো মানুষ ছুটে আসছে উৎসুক চোখে জাহাজ দেখতে। শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবাইকে টানছে এই বিরল দৃশ্য।
ঝড়ের রাতে ডুব
১৯৯২ সালের আগস্ট। বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বোঝাই করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খুলনার উদ্দেশে যাত্রা করেছিল এমভি মোস্তাবি। মেহেন্দীগঞ্জের আলিমাবাদ ইউনিয়নের মিঠুয়া ঘাটের কাছে আচমকাই ঝড়ে তেঁতুলিয়ায় তলিয়ে যায় জাহাজ। আংশিক মালামাল উদ্ধার হলেও নদীর গর্ভে হারিয়ে যায় ১৮০ ফুট দীর্ঘ ওই বিদেশি জাহাজ।
সেই থেকে জাহাজ উদ্ধারে চেষ্টা হয়েছে একাধিকবার।
ঢাকা ও খুলনার কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোটি টাকা খরচ করেও ব্যর্থ হয়েছে। ভারী যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে, ডুবুরি নামানো হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই মাটি ভেদ করে উঠে আসেনি জাহাজ। কারণ জাহাজটি ডোবার পর নদীর প্রবল স্রোত আর চরজমার কারণে সেটি প্রায় ৭০ হাত নিচে চাপা পড়ে। ফলে সাধারণ যন্ত্র দিয়ে কাজ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এরপর কালের নিয়মে তেঁতুলিয়া নদী বদলে যায়। সময়ের স্রোতে নদী সরে গিয়ে জায়গা করে নেয় নতুন চর। পলি জমে নতুন চর জাগে। জন্ম নেয় চর মিঠুয়া গ্রাম। ধানক্ষেত, বসতি, মানুষের জীবন-সবকিছুর তলায় নিঃশব্দে চাপা পড়ে থাকে হারানো ইতিহাস।
বিগত তিন দশকে বহুবার চেষ্টা হয়েছে জাহাজ উদ্ধারের। কোটি টাকার প্রকল্প গড়িয়েছে পানিতে। ভারী কাঠামো আর মাটির গভীরে আটকে থাকা লৌহদেহ উদ্ধার করা যায়নি কোনোভাবেই।
দীর্ঘ অভিযানের পর উদ্ধার
২০০৫ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) আনুষ্ঠানিকভাবে টেন্ডার আহ্বান করে। খুলনার ঠিকাদার আনসার উদ্দিন মিয়ার প্রতিষ্ঠান মেসার্স অগ্রণী ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট প্রায় ২০ লাখ টাকায় কাজ পায়। কিন্তু কাজ এত কঠিন যে একা তিনি এগোতে পারেননি।
পরে সাব-কন্ট্রাক্ট নেন ইউসুফ মিয়া। ২০১২ সাল থেকে তিনি শুরু করেন উদ্ধার অভিযান। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে অবশেষে সফলতা মেলে।
প্রায় পাঁচ একর জমি খনন, তিনটি শক্তিশালী বিকেবার্স, বিশেষ ক্রেন, ডুবুরি দল-সব মিলিয়ে পরিচালিত হয় অভিযান। মাটির ৭০ হাত নিচ থেকে বিশাল দেহরাশি তুলে আনা হয়।
অভিজ্ঞ কর্মী আব্দুল মান্নান বলেন, ১৯৮৮ সাল থেকে বন্দর এলাকায় কাজ করছি। কিন্তু এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়িনি। একেবারে নদীর বুকে কবর দেওয়া জাহাজ তুলতে গিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে।
দৈর্ঘ্য ১৮০ ফুট, প্রস্থ ১৪ ফুট, উচ্চতা ১৭ ফুটের জাহাজের ভেতরে মেলে দুষ্প্রাপ্য মেশিন। বাজারে এ মেশিনের নতুন সংস্করণের দাম ১৪ থেকে ১৫ কোটি টাকা। বিকল অবস্থাতেও ভাঙারির বাজারে কমপক্ষে ২৫ লাখ টাকার।
মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রিয়াজুর রহমান বলেন, বিআইডব্লিউটিএ-এর নিয়ম মেনেই উদ্ধারকাজ হয়েছে। ৩৩ বছর আগের ইতিহাস আজ নতুন করে সামনে এসেছে। মানুষকে টেনে আনছে এই বিস্ময়।

দৈনিক দেশ নিউজ ডটকম ডেস্ক 

























