মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

খালেদা জিয়ার আলোচিত কিছু ভাষণ

বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল ৬টার দিকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

দীর্ঘ চার দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে খালেদা জিয়ার এমন কিছু ভাষণ রয়েছে, যা রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে পরিচিত। তাঁর ভাষণগুলো কখনো রাজপথের উত্তাপ বাড়িয়েছে, কখনো বা জাতীয় সংকটে দিকনির্দেশনা দিয়েছে।

খালেদা জিয়ার বেশিরভাগ ভাষণ ছিল রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও ‘আপসহীন’ অবস্থানের প্রতিফলন।

রাজনীতিতে পা রাখার প্রথম ভাষণ: ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বেগম জিয়া যখন রাজনীতিতে নামার সিদ্ধান্ত নেন, তখন ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর স্বামী জিয়ার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তিনি প্রথম সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। এটি ছিল তার রাজনৈতিক যাত্রার আনুষ্ঠানিক সূচনা। এই ভাষণে তিনি জিয়ার আদর্শ ধরে রাখার এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংকল্প ব্যক্ত করেছিলেন।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ভাষণ: নব্বইয়ের দশকে এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় খালেদা জিয়ার প্রতিটি জনসভার ভাষণ ছিল উদ্দীপনামূলক।

৮ দল, ৭ দল ও ৫ দলের রূপরেখা: ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে এবং পরবর্তীতে ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানে খালেদা  জিয়ার ভাষণগুলো ছাত্র-জনতাকে রাজপথে নামতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই সময়ে তার ভাষণে ‘স্বৈরাচার বিদায় করো, গণতন্ত্র মুক্ত করো’ স্লোগানটি প্রধান হয়ে ওঠে।

সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরার ভাষণ: ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এই ভাষণে তিনি প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরার অঙ্গীকার করেছিলেন, যা দেশের শাসনব্যবস্থায় এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন আনে।

জাতীয় সংসদে বাজেট ও নীতি নির্ধারণী ভাষণ: নবম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে ২০১৩ সালের জুন মাসে তিনি এক দীর্ঘ ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরিহার, জাতীয় নেতাদের যথাযথ সম্মান প্রদান এবং তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন নীতির কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেছিলেন, “আমরা কাউকে খাটো করে দেখতে চাই না। সকলকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে চাই। প্রত্যেকের সাফল্য ও ব্যর্থতা মূল্যায়নের ভার ছেড়ে দিতে চাই ইতিহাসের ওপর।”

কারাবরণের আগের ঐতিহাসিক সংবাদ সম্মেলন: ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারিতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় হওয়ার মাত্র একদিন আগে গুলশানে খালেদা জিয়া এক আবেগঘন সংবাদ সম্মেলন করেন। এটি সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম আলোচিত ভাষণ। খালেদা জিয়া দাবি করেন, তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি। তিনি বলেন, “আপনাদের খালেদা জিয়া কোনো অন্যায় করেনি। ন্যায়বিচার হলে বেকসুর খালাস পাব।” নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, “বিচারের নামে প্রহসন হলে সেটি হবে ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।” তিনি প্রতিহিংসার বদলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন।

২০২৪-এর ছাত্র-জনতার বিপ্লব পরবর্তী ভাষণ: দীর্ঘদিন কারাবন্দী ও অসুস্থ থাকার পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ৭ আগস্ট নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে তিনি ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। বক্তব্যে তিনি তিনি প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি ভুলে নতুন বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানান। বেগম খালেদা জিয়া বলেন, “ধ্বংস নয়, প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসা ও শান্তির মাধ্যমে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।”

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সর্বাধিক পঠিত

খালেদা জিয়ার আলোচিত কিছু ভাষণ

প্রকাশিত সময় : ১১:০৬:৫১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫

বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল ৬টার দিকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

দীর্ঘ চার দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে খালেদা জিয়ার এমন কিছু ভাষণ রয়েছে, যা রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে পরিচিত। তাঁর ভাষণগুলো কখনো রাজপথের উত্তাপ বাড়িয়েছে, কখনো বা জাতীয় সংকটে দিকনির্দেশনা দিয়েছে।

খালেদা জিয়ার বেশিরভাগ ভাষণ ছিল রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও ‘আপসহীন’ অবস্থানের প্রতিফলন।

রাজনীতিতে পা রাখার প্রথম ভাষণ: ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বেগম জিয়া যখন রাজনীতিতে নামার সিদ্ধান্ত নেন, তখন ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর স্বামী জিয়ার সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তিনি প্রথম সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। এটি ছিল তার রাজনৈতিক যাত্রার আনুষ্ঠানিক সূচনা। এই ভাষণে তিনি জিয়ার আদর্শ ধরে রাখার এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংকল্প ব্যক্ত করেছিলেন।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ভাষণ: নব্বইয়ের দশকে এইচ এম এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় খালেদা জিয়ার প্রতিটি জনসভার ভাষণ ছিল উদ্দীপনামূলক।

৮ দল, ৭ দল ও ৫ দলের রূপরেখা: ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে এবং পরবর্তীতে ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানে খালেদা  জিয়ার ভাষণগুলো ছাত্র-জনতাকে রাজপথে নামতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এই সময়ে তার ভাষণে ‘স্বৈরাচার বিদায় করো, গণতন্ত্র মুক্ত করো’ স্লোগানটি প্রধান হয়ে ওঠে।

সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরার ভাষণ: ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এই ভাষণে তিনি প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরার অঙ্গীকার করেছিলেন, যা দেশের শাসনব্যবস্থায় এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন আনে।

জাতীয় সংসদে বাজেট ও নীতি নির্ধারণী ভাষণ: নবম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে ২০১৩ সালের জুন মাসে তিনি এক দীর্ঘ ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরিহার, জাতীয় নেতাদের যথাযথ সম্মান প্রদান এবং তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন নীতির কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেছিলেন, “আমরা কাউকে খাটো করে দেখতে চাই না। সকলকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে চাই। প্রত্যেকের সাফল্য ও ব্যর্থতা মূল্যায়নের ভার ছেড়ে দিতে চাই ইতিহাসের ওপর।”

কারাবরণের আগের ঐতিহাসিক সংবাদ সম্মেলন: ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারিতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় হওয়ার মাত্র একদিন আগে গুলশানে খালেদা জিয়া এক আবেগঘন সংবাদ সম্মেলন করেন। এটি সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম আলোচিত ভাষণ। খালেদা জিয়া দাবি করেন, তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি। তিনি বলেন, “আপনাদের খালেদা জিয়া কোনো অন্যায় করেনি। ন্যায়বিচার হলে বেকসুর খালাস পাব।” নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, “বিচারের নামে প্রহসন হলে সেটি হবে ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।” তিনি প্রতিহিংসার বদলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন।

২০২৪-এর ছাত্র-জনতার বিপ্লব পরবর্তী ভাষণ: দীর্ঘদিন কারাবন্দী ও অসুস্থ থাকার পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ৭ আগস্ট নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে তিনি ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। বক্তব্যে তিনি তিনি প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি ভুলে নতুন বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানান। বেগম খালেদা জিয়া বলেন, “ধ্বংস নয়, প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসা ও শান্তির মাধ্যমে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।”