মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

খালেদা জিয়ার অবিচল সঙ্গী ছিলেন ফাতেমা বেগম

দেড় দশকদের বেশি সময় ধরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম। কারাজীবনের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে শুরু করে নিজ বাসভবন গৃহবন্দী থাকা বা বিদেশে সফরে— সব জায়গাতে সঙ্গী হয়ে আমৃত্যু খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন তিনি।

ফাতেমা বেগম গৃহকর্মীর ঊর্ধ্বে হয়ে উঠেছিলেন একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী। বাথরুমে আনা-নেওয়া থেকে শুরু করে মুখে তুলে ওষুধ খাওয়ানোর মতো কাজগুলো করতেন তিনি।

ফাতেমার পারিবারিক জীবন 
ফাতেমার বেগমের গ্রামের বাড়ি ভোলার সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের শাহ-মাদার গ্রাম। রফিকুল ইসলাম ও মালেকা বেগম দম্পতির ৫ সন্তানের মধ্যে সবার বড় তিনি।

২০২৩ সালের শেষ দিক। একই ইউনিয়নের কৃষক মো হারুন লাহাড়ির সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ঘর আলো করে আসে মেয়ে জাকিয়া ইসলাম রিয়া ও ছেলে মো. রিফাত। মেঘনা নদের চরে কৃষি কাজ করেই চলতো সংসার। ছেলেটার বয়স তখন মাত্র ২ বছর, ২০০৮ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান তার স্বামী। স্বামীর মৃত্যুর পর ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে দুঃখের সাগরে পড়েন ফাতেমা।

ফাতেমা যেভাবে যুক্ত হলেন জিয়া পরিবারে
স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের নিয়ে ওঠেন মা-বাবার বাসায়। মুদি দোকানি বাবার আয় দিয়ে সংসার যেন আর চলে না। স্বামীর মৃত্যুর এক বছরের মাত্রায় মা-বাবার কাছে সন্তানদের রেখে ২০০৯ সালে কাজের খোঁজে ঢাকায় আসেন ফাতেমা। ওই বছরেই পূর্ব পরিচিত এক ব্যক্তি মাধ্যমে খালেদা জিয়ার গৃহকর্মী হিসেবে কাজের সুযোগ পান ফাতেমা। আর তখন থেকেই যেখানে খালেদা জিয়া সেখানেই ফাতেমা। তেমন কোনো চাওয়া-পাওয়া ছাড়ায় আমৃত্যু খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন তিনি। প্রতিকূল-অনুকূল সব পরিবেশেই ফামেতা তার দায়িত্বে ছিলেন অবিচল।

যখন দেশবাসীর নজরে পড়েন ফাতেমা 
ফাতেমা দেশবাসীর নজর কাড়েন ২০১৪ সালে মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচিতে।

২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের বিরোধিতা করে বিএনপি আন্দোলন শুরু করে এবং বিভিন্ন দাবি দাওয়া তুলে ধরে। সেসময় আওয়ামী লীগ সরকার সব দাবি প্রত্যাখ্যান করে ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচন করার প্রস্তুতি নেয়। এর প্রতিবাদে ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিএনপি ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। নয়াপল্টনের আয়োজিত ওই কর্মসূচিতে বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও পরিকল্পিতভাবে গুলশানের বাসার সামনে ৫ থেকে ৬টি বালুর ট্রাক দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়

রওনা হওয়ার জন্য বেশ কিছু সময় গাড়িতে উঠে বসে থাকলেও রওনা হতে না পেরে নেমে এসে প্রথমে পুলিশের সঙ্গে এবং পরে মই ও পাইপ বেয়ে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢোকা গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে মিনিট দশেক কথা বলেন তিনি। বেগম জিয়া ওই সময় তার বাসভবন ফিরোজার দোরগোড়ায় পুলিশের চাপে ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছিলেন না, তখনও ফাতেমা ছিলেন তার পাশে, শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন তার হাত।

কারাগারেও খালেদা জিয়ার সঙ্গী ফাতেমা
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। রায় ঘোষণার পরই সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীকে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়।

ওই দিন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আদালতে খালেদার গৃহকর্মী ফাতেমা বেগমকে তাঁর সঙ্গে দেওয়াসহ ডিভিশনের জন্য আবেদন করেন। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি আদালত কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেন খালেদা জিয়াকে ডিভিশন দেওয়ার জন্য। একই সঙ্গে ফাতেমাকে সঙ্গে রাখার আবেদনও আদালত মঞ্জুর করেন। খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর ছয় দিনের মাথায় ফাতেমা তার সঙ্গে থাকার অনুমতি পান। কঠিন ওই সময়েও যেন খালেদা জিয়াকে একা ছাড়েননি তিনি। স্বেচ্ছায় বেগম জিয়ার সঙ্গী হতে হয়েছিলেন কারাবন্দি।

হাসপাতালেও খালেদা জিয়ার পাশে ফাতেমা
২০২১ সালের ১০ এপ্রিল নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার অংশ হিসাবে রক্তের নমুনা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। পরদিন ১১ এপ্রিল জানা যায় তিনি করোনায় আক্রান্ত। প্রথমে বাসায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হলেও ২৭ এপ্রিল থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত দীর্ঘ ৫৩ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। করোনা মহামারির এমন সময়ে যখন মানুষ তার প্রিয়জনদের পাশে থাকতেও ভয় পাচ্ছিলেন তখনও সাহসের সাথে সেবিকা হয়ে যেন নানান রোগে আক্রান্ত খালেদা জিয়ার সেবাযত্ন করেছেন ফাতেমা বেগম।

লন্ডনেও খালেদা জিয়ার সঙ্গী ছিলেন ফাতেমা
সর্বশেষ গত ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নেওয়া হয় বিএনপি চেয়ারপারসনকে। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ফাতেমা। শুধু এবারই নয়, এর আগেও একাধিকাবার খালেদা জিয়ার বিদেশ সফরেও সঙ্গী হন তিনি।

ফামেতার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। তিনি যেন মানবিকতা দিয়ে জিতেছেন সবার হৃদয়। গৃহকর্মীর ঊর্ধ্বে গিয়ে হয়ে ওঠেন যেন পরিবারেরই একজন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সর্বাধিক পঠিত

খালেদা জিয়ার অবিচল সঙ্গী ছিলেন ফাতেমা বেগম

প্রকাশিত সময় : ১১:৪১:০৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫

দেড় দশকদের বেশি সময় ধরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম। কারাজীবনের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে শুরু করে নিজ বাসভবন গৃহবন্দী থাকা বা বিদেশে সফরে— সব জায়গাতে সঙ্গী হয়ে আমৃত্যু খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন তিনি।

ফাতেমা বেগম গৃহকর্মীর ঊর্ধ্বে হয়ে উঠেছিলেন একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী। বাথরুমে আনা-নেওয়া থেকে শুরু করে মুখে তুলে ওষুধ খাওয়ানোর মতো কাজগুলো করতেন তিনি।

ফাতেমার পারিবারিক জীবন 
ফাতেমার বেগমের গ্রামের বাড়ি ভোলার সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের শাহ-মাদার গ্রাম। রফিকুল ইসলাম ও মালেকা বেগম দম্পতির ৫ সন্তানের মধ্যে সবার বড় তিনি।

২০২৩ সালের শেষ দিক। একই ইউনিয়নের কৃষক মো হারুন লাহাড়ির সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ঘর আলো করে আসে মেয়ে জাকিয়া ইসলাম রিয়া ও ছেলে মো. রিফাত। মেঘনা নদের চরে কৃষি কাজ করেই চলতো সংসার। ছেলেটার বয়স তখন মাত্র ২ বছর, ২০০৮ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান তার স্বামী। স্বামীর মৃত্যুর পর ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে দুঃখের সাগরে পড়েন ফাতেমা।

ফাতেমা যেভাবে যুক্ত হলেন জিয়া পরিবারে
স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের নিয়ে ওঠেন মা-বাবার বাসায়। মুদি দোকানি বাবার আয় দিয়ে সংসার যেন আর চলে না। স্বামীর মৃত্যুর এক বছরের মাত্রায় মা-বাবার কাছে সন্তানদের রেখে ২০০৯ সালে কাজের খোঁজে ঢাকায় আসেন ফাতেমা। ওই বছরেই পূর্ব পরিচিত এক ব্যক্তি মাধ্যমে খালেদা জিয়ার গৃহকর্মী হিসেবে কাজের সুযোগ পান ফাতেমা। আর তখন থেকেই যেখানে খালেদা জিয়া সেখানেই ফাতেমা। তেমন কোনো চাওয়া-পাওয়া ছাড়ায় আমৃত্যু খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন তিনি। প্রতিকূল-অনুকূল সব পরিবেশেই ফামেতা তার দায়িত্বে ছিলেন অবিচল।

যখন দেশবাসীর নজরে পড়েন ফাতেমা 
ফাতেমা দেশবাসীর নজর কাড়েন ২০১৪ সালে মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচিতে।

২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের বিরোধিতা করে বিএনপি আন্দোলন শুরু করে এবং বিভিন্ন দাবি দাওয়া তুলে ধরে। সেসময় আওয়ামী লীগ সরকার সব দাবি প্রত্যাখ্যান করে ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচন করার প্রস্তুতি নেয়। এর প্রতিবাদে ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিএনপি ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। নয়াপল্টনের আয়োজিত ওই কর্মসূচিতে বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও পরিকল্পিতভাবে গুলশানের বাসার সামনে ৫ থেকে ৬টি বালুর ট্রাক দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়

রওনা হওয়ার জন্য বেশ কিছু সময় গাড়িতে উঠে বসে থাকলেও রওনা হতে না পেরে নেমে এসে প্রথমে পুলিশের সঙ্গে এবং পরে মই ও পাইপ বেয়ে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢোকা গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে মিনিট দশেক কথা বলেন তিনি। বেগম জিয়া ওই সময় তার বাসভবন ফিরোজার দোরগোড়ায় পুলিশের চাপে ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছিলেন না, তখনও ফাতেমা ছিলেন তার পাশে, শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন তার হাত।

কারাগারেও খালেদা জিয়ার সঙ্গী ফাতেমা
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। রায় ঘোষণার পরই সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীকে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়।

ওই দিন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আদালতে খালেদার গৃহকর্মী ফাতেমা বেগমকে তাঁর সঙ্গে দেওয়াসহ ডিভিশনের জন্য আবেদন করেন। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি আদালত কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেন খালেদা জিয়াকে ডিভিশন দেওয়ার জন্য। একই সঙ্গে ফাতেমাকে সঙ্গে রাখার আবেদনও আদালত মঞ্জুর করেন। খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর ছয় দিনের মাথায় ফাতেমা তার সঙ্গে থাকার অনুমতি পান। কঠিন ওই সময়েও যেন খালেদা জিয়াকে একা ছাড়েননি তিনি। স্বেচ্ছায় বেগম জিয়ার সঙ্গী হতে হয়েছিলেন কারাবন্দি।

হাসপাতালেও খালেদা জিয়ার পাশে ফাতেমা
২০২১ সালের ১০ এপ্রিল নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার অংশ হিসাবে রক্তের নমুনা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। পরদিন ১১ এপ্রিল জানা যায় তিনি করোনায় আক্রান্ত। প্রথমে বাসায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হলেও ২৭ এপ্রিল থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত দীর্ঘ ৫৩ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। করোনা মহামারির এমন সময়ে যখন মানুষ তার প্রিয়জনদের পাশে থাকতেও ভয় পাচ্ছিলেন তখনও সাহসের সাথে সেবিকা হয়ে যেন নানান রোগে আক্রান্ত খালেদা জিয়ার সেবাযত্ন করেছেন ফাতেমা বেগম।

লন্ডনেও খালেদা জিয়ার সঙ্গী ছিলেন ফাতেমা
সর্বশেষ গত ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নেওয়া হয় বিএনপি চেয়ারপারসনকে। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন ফাতেমা। শুধু এবারই নয়, এর আগেও একাধিকাবার খালেদা জিয়ার বিদেশ সফরেও সঙ্গী হন তিনি।

ফামেতার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। তিনি যেন মানবিকতা দিয়ে জিতেছেন সবার হৃদয়। গৃহকর্মীর ঊর্ধ্বে গিয়ে হয়ে ওঠেন যেন পরিবারেরই একজন।