টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মধুপুরের বনাঞ্চলের নির্জন এলাকায় গত ১৩ বছরে চারবার চলন্ত বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এ সকল ঘটনায় তিনজন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। খুন হয়েছেন দুই নারী।
স্থানীয়রা বলছেন, এর বাইরেও ছোটখাটো অনেক ঘটনা ঘটে। ছোটখাটো ঘটনা খুব একটা জানাজানি হয় না। আবার অনেক সময়ই ভুক্তভোগীরা পুলিশে অভিযোগ করেন না। অপরাধীরা সহজেই পালাতে পারছে বলে বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পর্যাপ্ত নিরাপত্তা থাকলে এ ধরনের ঘটনা রোধ করা সম্ভব বলে তারা জানান।
পুলিশ, ভুক্তভোগী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বাসন্তী মাংসাং বনাঞ্চলের জলছত্র থেকে টেলকি যাচ্ছিলেন। তার সঙ্গে স্কুলের শিশুদের টাকা ছিল। পথিমধ্যে ডাকাতদল বাসন্তীকে কুপিয়ে হত্যা করে টাকা লুটে নিয়ে যায়। পরে বাসন্তীর স্বামী যতীশ নকরেক বাদী হয়ে মামলা করেন।
মামলার বিষয়ে বাসন্তীর স্বামী যতীশ নকরেক বলেন, মামলা এখনো চলমান। আসামিরা জামিনে বের হয়ে গেছে। আমি আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিলেও ওরা আসে না। বিচার নিয়ে আমি সন্দিহান। ডাকাতদের যথাযথ বিচার চাই।
২০১৬ সালের ১ এপ্রিল এক নারী পোশাককর্মী টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে ভোর ৫টার দিকে ‘বিনিময় পরিবহনের’ একটি বাসে কালিয়াকৈরের উদ্দেশে রওনা দেন। বাসে আর কোনো যাত্রী ছিল না। বাসটি কিছুদূর যাওয়ার পর চালকের সহকারী (হেলপার) বাসের জানালা-দরজা বন্ধ করে দেন। পরে গাড়ির চালক হাবিবুর রহমান নয়ন তাকে পেছনের আসনে নিয়ে ধর্ষণ করেন।এরপর বাসের অন্য দুই সহযোগীও ওই নারীকে ধর্ষণ করেন।এরপর টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের একটি ফাঁকা জায়গায় ওই নারীকে নামিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায় তারা। পরে ওই নারীর স্বামী বাদী হয়ে টাঙ্গাইল মডেল থানায় ৯ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। পুলিশ তদন্ত শেষে চারজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দিয়ে ছয়জনকে অব্যাহতি দেয়।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতের তৎকালীন বিশেষ পিপি নাসিমুল আক্তার বলেন, ২০১৯ সালের ২২ মে মামলার রায়ে চারজনকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। পরে আসামিরা উচ্চ আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়া থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে সিরাজগঞ্জের জাকিয়া সুলতানা রূপাকে চলন্ত বাসে পরিবহন শ্রমিকরা ধর্ষণ করেন। পরে তাকে হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় ফেলে যায় তারা। পুলিশ ওই রাতেই তার লাশ উদ্ধার করে। ময়নাতদন্ত শেষে পরদিন বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। ২০১৮ সালে গণধর্ষণ ও হত্যা মামলায় চার আসামির মৃত্যুদণ্ড ও একজনের সাত বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। জব্দকৃত ছোঁয়া পরিবহনের বাসটি রূপার পরিবারকে হস্তান্তর করার নির্দেশও দেন আদালত।
রূপার ভাই হাফিজুর রহমান বলেন, মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। কবে মামলার রায় কার্যকর হবে সেটা নিয়ে আমরা সংশয়ে আছি।
সর্বশেষ কুষ্টিয়া থেকে ছেড়ে আসা ঈগল পরিবহনের বাসটি বুধবার ভোরে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কের মধুপুর উপজেলার রক্তিপাড়া জামে মসজিদের পাশে বালুর স্তুপে রেখে ডাকাতদল পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় হেকমত আলী নামে এক যাত্রী বাদী হয়ে মামলা করেছেন। ডাকাতরা বাসযাত্রী এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। ইতিমধ্যে ওই নারী আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেছেন। বাসটিতে ২৪ থেকে ২৫ জন যাত্রী ছিল। এর মধ্যে ছয় থেকে সাতজন নারী যাত্রী ছিল। বাসের সবাইকে জিম্মি করে টাকা, স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোন লুট করে নেয় ডাকাতরা।এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে রাজা মিয়া ৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।
জেলা পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকেই পুলিশের একাধিক দল মাঠে নামে। ইতিমধ্যে ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত অন্যদেরও খুব শিগগিরই গ্রেফতার করা হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
মধুপুরের জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, এই বনাঞ্চল এলাকার নির্জন স্থানে ধর্ষণসহ প্রায়ই ছোটখাটো অপরাধ সংঘঠিত হয়। কিছু ঘটনা জানাজানি হয়, আবার অনেক ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমলজি ও পুলিশ সাইন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যক্ষ জহিরুল ইসলাম বলেন, যেকোন ধরনের অপরাধীরা অপরাধ সংগঠিত করার জন্য সীমান্তবর্তী এলাকা, পাহাড়ি ও নির্জন এলাকা খুঁজে। সেই দিক চিন্তা করলে মধুপুর বনাঞ্চল নির্জন এলাকাকে অপরাধীরা নিরাপদ মনে করে। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সড়কে, বিশেষ করে মধুপুর এলাকায় সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত জোরদার পুলিশি টহল থাকলে এ অপরাধগুলো কম সংগঠিত হতো।
টাঙ্গাইল জেলা মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আজাদ বলেন, ডাকাতদল ও অপরাধীরা মধুপুরের নির্জন স্থানে নিয়মিত অঘটন ঘটাচ্ছে। এ সড়কে মানুষের জানমাল হুমকির মুখে পড়ে। মধুপর বনাঞ্চলের জলছত্র থেকে রসুলপর পর্যন্ত আগে প্রায়ই পরিবহনে ডাকাতি হতো। তখন পুলিশ যাত্রীদের একত্রিত করে পাহারা দিয়ে অনিরাপদ সড়কটুকু পাড় করে দিত। এখন আর সে ব্যবস্থা নেই। ফলে রাতে চলাচলকারী যাত্রীরা অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হলেই বাসে এ ধরনের ঘটনা কমে যাবে।

দৈনিক দেশ নিউজ ডটকম ডেস্ক 
























