শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইরানের এক শহরের নিয়ন্ত্রণ বিক্ষোভকারীদের হাতে

সঠিক নিয়মে হিজাব না পরার অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের হেফাজতে মাশা আমিনি নামে এক তরুণীর মৃত্যুতে ইরানে নারীর পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে শুরু হওয়া বিক্ষোভ থামছেই না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর মাত্রা বাড়ছে এবং পরিস্থিতি ইরানি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

কয়েকটি টুইটার ভিডিওর আলোকে ডয়চে ভেলে ফার্সির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর এই প্রথমবারের মতো ইরানের পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের আশনোয় শহরের নিয়ন্ত্রণ বিক্ষোভকারীদের হাতে।

তাওহিদ জাভাদি নামে একজন গণমাধ্যমকর্মী টুইটবার্তায় লিখেছেন, ১৯৫৭ সালের পর প্রথমবারের মতো একটি শহর সম্পূর্ণরূপে বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। টুইটারে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, শহর ছেড়ে মোটরবাইকে করে পালাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।

এদিকে তেহরানের রাস্তা থেকে প্রকাশ করা এক ভিডিওতে বিক্ষোভকারীরা দাবি করেছে, বিক্ষোভকারী জনতা তেহরানের সব রাস্তা দখল করেছে। তবে নিরপেক্ষভাবে এসব দাবির সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

ইন্টারনেটে হস্তক্ষেপ, ইনস্টাগ্রাম-হোয়াটসঅ্যাপ ব্লক করা, আইআরজিসি ও বিচার বিভাগের হুমকি, এমনকি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি। কোনো কিছুই থামাতে পারছে না নৈতিকতা পুলিশের হেফাজতে থাকা মাহসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চলা ইরানে চলমান বিক্ষোভ।

ইরানের বেশ কয়েকটি শহরে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘাত হয়েছে। ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে সরকারি এজেন্টকে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকা মানুষেরা তাকে গুলি না ছুড়তে অনুরোধ করলেও এজেন্ট কথা শোনেনি। এরই মধ্যে অনলাইনে তার ছবি প্রকাশ করা হয়েছে।

অন্য একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, তেহরানের রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। শুক্রবার রাতে ইরানের অনেক শহরে রাস্তায় মানুষজন বিক্ষোভ করেছে। তারা এ সময় ‘খামেনির মৃত্যু’, ‘স্বৈরশাসকের মৃত্যু’ এবং ‘আমরা জেগে উঠব’ স্লোগান দেয়।

বিক্ষুব্ধরা ‘আমরা মরব, আমরা ইরানকে ফিরিয়ে নেব’ স্লোগানও দেয়। সন্ধ্যার পরও যখন অন্ধকার নেমে এসেছে, তখনও বিক্ষোভকারীদের আন্দোলন থামেনি। তেহরান, খোরমাবাদ, আরদাবিল, ইসফাহান, কেরমানশাহ এবং কারাজের বিভিন্ন এলাকায় রাতেও বিক্ষোভ হয়েছে।

বেশির ভাগ শহরে, বিক্ষোভকারীরা খামেনিসহ ইসলামি প্রজাতন্ত্রের নেতাদের ছবি ছিঁড়ে ফেলেছে। মাশহাদ শহরের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীরা ইসলামি বিপ্লবের নেতা ‘মুর্তেজা মোতাহারির’ মূর্তিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এছাড়া ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির ভাস্কর্যেও আগুন দিতে দেখা গেছে। এমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি।

মাথায় হিজাব না থাকায় গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানী তেহরানে ইরানের নৈতিকতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন মাশা আমিনি নামের ২২ বছরের এক তরুণী। গ্রেপ্তার করে হেফাজতে নিয়ে যাওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।

পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ৩ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় মাশার। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়াই তার মৃত্যুর কারণ; তবে বিক্ষোভকারী, মাশার পরিবার ও স্বজনদের অভিযোগ- মাথায় গুরুতর আঘাত করার পরই অজ্ঞান হয়ে কোমায় চলে যান মাশা এবং ওই আঘাতের জেরেই তার মৃত্যু হয়।

তার মৃত্যুর খবর প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল কুর্দিস্তানে। পরে দ্রুততার সঙ্গে অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়ে সেই বিক্ষোভ। আইএইচআরের তথ্য অনুযায়ী, ইসফাহান, মাশহাদ, শিরাজ, তাবরিজসহ ইরানের অন্তত ৮০টি শহরে বর্তমানে বিক্ষোভ চলছে। পুলিশের গুলিতে ইতিমধ্যেই নিহত হয়েছেন ৫১ জন। আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবি- মাশা আমিনির মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা এবং নারীদের কঠোর পোষাকনীতি ও নৈতিক পুলিশ বাতিল করা।

হিজাব আইন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগের জন্য চলতি বছরের ৫ জুলাই ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি একটি আদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে ‘সঠিক নিয়মে’এবং ইসলামি পোশাক না পরা নারীদের সরকারি সব অফিস, ব্যাংক এবং গণপরিবহনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সর্বাধিক পঠিত

ইরানের এক শহরের নিয়ন্ত্রণ বিক্ষোভকারীদের হাতে

প্রকাশিত সময় : ০৯:৩৯:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২

সঠিক নিয়মে হিজাব না পরার অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের হেফাজতে মাশা আমিনি নামে এক তরুণীর মৃত্যুতে ইরানে নারীর পোশাকের স্বাধীনতার দাবিতে শুরু হওয়া বিক্ষোভ থামছেই না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর মাত্রা বাড়ছে এবং পরিস্থিতি ইরানি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

কয়েকটি টুইটার ভিডিওর আলোকে ডয়চে ভেলে ফার্সির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর এই প্রথমবারের মতো ইরানের পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের আশনোয় শহরের নিয়ন্ত্রণ বিক্ষোভকারীদের হাতে।

তাওহিদ জাভাদি নামে একজন গণমাধ্যমকর্মী টুইটবার্তায় লিখেছেন, ১৯৫৭ সালের পর প্রথমবারের মতো একটি শহর সম্পূর্ণরূপে বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। টুইটারে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, শহর ছেড়ে মোটরবাইকে করে পালাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।

এদিকে তেহরানের রাস্তা থেকে প্রকাশ করা এক ভিডিওতে বিক্ষোভকারীরা দাবি করেছে, বিক্ষোভকারী জনতা তেহরানের সব রাস্তা দখল করেছে। তবে নিরপেক্ষভাবে এসব দাবির সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

ইন্টারনেটে হস্তক্ষেপ, ইনস্টাগ্রাম-হোয়াটসঅ্যাপ ব্লক করা, আইআরজিসি ও বিচার বিভাগের হুমকি, এমনকি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি। কোনো কিছুই থামাতে পারছে না নৈতিকতা পুলিশের হেফাজতে থাকা মাহসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চলা ইরানে চলমান বিক্ষোভ।

ইরানের বেশ কয়েকটি শহরে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘাত হয়েছে। ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে সরকারি এজেন্টকে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকা মানুষেরা তাকে গুলি না ছুড়তে অনুরোধ করলেও এজেন্ট কথা শোনেনি। এরই মধ্যে অনলাইনে তার ছবি প্রকাশ করা হয়েছে।

অন্য একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, তেহরানের রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। শুক্রবার রাতে ইরানের অনেক শহরে রাস্তায় মানুষজন বিক্ষোভ করেছে। তারা এ সময় ‘খামেনির মৃত্যু’, ‘স্বৈরশাসকের মৃত্যু’ এবং ‘আমরা জেগে উঠব’ স্লোগান দেয়।

বিক্ষুব্ধরা ‘আমরা মরব, আমরা ইরানকে ফিরিয়ে নেব’ স্লোগানও দেয়। সন্ধ্যার পরও যখন অন্ধকার নেমে এসেছে, তখনও বিক্ষোভকারীদের আন্দোলন থামেনি। তেহরান, খোরমাবাদ, আরদাবিল, ইসফাহান, কেরমানশাহ এবং কারাজের বিভিন্ন এলাকায় রাতেও বিক্ষোভ হয়েছে।

বেশির ভাগ শহরে, বিক্ষোভকারীরা খামেনিসহ ইসলামি প্রজাতন্ত্রের নেতাদের ছবি ছিঁড়ে ফেলেছে। মাশহাদ শহরের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীরা ইসলামি বিপ্লবের নেতা ‘মুর্তেজা মোতাহারির’ মূর্তিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এছাড়া ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির ভাস্কর্যেও আগুন দিতে দেখা গেছে। এমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি।

মাথায় হিজাব না থাকায় গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানী তেহরানে ইরানের নৈতিকতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন মাশা আমিনি নামের ২২ বছরের এক তরুণী। গ্রেপ্তার করে হেফাজতে নিয়ে যাওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।

পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ৩ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় মাশার। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়াই তার মৃত্যুর কারণ; তবে বিক্ষোভকারী, মাশার পরিবার ও স্বজনদের অভিযোগ- মাথায় গুরুতর আঘাত করার পরই অজ্ঞান হয়ে কোমায় চলে যান মাশা এবং ওই আঘাতের জেরেই তার মৃত্যু হয়।

তার মৃত্যুর খবর প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল কুর্দিস্তানে। পরে দ্রুততার সঙ্গে অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়ে সেই বিক্ষোভ। আইএইচআরের তথ্য অনুযায়ী, ইসফাহান, মাশহাদ, শিরাজ, তাবরিজসহ ইরানের অন্তত ৮০টি শহরে বর্তমানে বিক্ষোভ চলছে। পুলিশের গুলিতে ইতিমধ্যেই নিহত হয়েছেন ৫১ জন। আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবি- মাশা আমিনির মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা এবং নারীদের কঠোর পোষাকনীতি ও নৈতিক পুলিশ বাতিল করা।

হিজাব আইন আরও কঠোরভাবে প্রয়োগের জন্য চলতি বছরের ৫ জুলাই ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি একটি আদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে ‘সঠিক নিয়মে’এবং ইসলামি পোশাক না পরা নারীদের সরকারি সব অফিস, ব্যাংক এবং গণপরিবহনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।