ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত। গতকাল রবিবার পর্যন্ত শেষ খবর- ইউক্রেনে হামলা জোরদার করেছে রাশিয়া। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি জানায়, গত শনিবার নতুন করে ‘ব্যাপক হামলা’ চালিয়েছে রাশিয়া। এসব হামলায় বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংস হওয়ায় ১৫ লাখ ঘরবাড়ি বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বলে জানান ইউক্রেনি কর্মকর্তারা। অন্যদিকে ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল রবিবার টেলিফোনে কথা বলেছেন রাশিয়া ও ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রীদ্বয়। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানায়, রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেবাস্তিয়ন লকোর্নুকে বলেছেন, ইউক্রেন এ যুদ্ধে ‘ডার্টি বম্ব’ ব্যবহার করতে পারে- এমন আশঙ্কা বাড়ছে এবং যুদ্ধ প্রলম্বিত হওয়ার দিকে ঝুঁকছে।
রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে যখন ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে, তখন খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইউক্রেনি ভূখ- রাশিয়ার দখলে চলে যাবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। রাশিয়ার সামরিক শক্তির হিসাব করে এমন খবর প্রচার করা হয়েছিল পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে। পশ্চিমা কর্মকর্তারা অনুমান করেছিলেন, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। ইউক্রেন ও রাশিয়ার সামরিক শক্তির তুলনা করে তারা এ অনুমান করেছিলেন; কিন্তু ২২ ফেব্রুয়ারির পর পুরো আট মাস পেরিয়ে গেলেও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মীমাংসা হয়নি, যুদ্ধ এখনো চলছে। বরং দিন দিন যুদ্ধের পরিধি বাড়ছে। রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কথায় পরিষ্কার ইঙ্গিত মিলছে, এ যুদ্ধ শিগগিরই শেষ হচ্ছে না।
গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার, স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও ন্যাটোর সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, রাশিয়া ও ইউক্রেনের সক্রিয় সেনাসদস্যের সংখ্যা যথাক্রমে ৮ লাখ ৫০ হাজার ও ২ লাখ। শুধু এ থেকেই দেশ দুটির সামরিক শক্তির ব্যবধান অনুমান করা যায়। যদিও ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও আরও কিছু দেশ সহযোগিতা দিচ্ছে, তা সত্ত্বেও রাশিয়ার পক্ষে ‘অভিযানের’ শুরুতেই কিয়েভ দখল করে জেলেনস্কির সরকার উৎখাত করা সম্ভব ছিল বলে মনে করেন পশ্চিমা সামরিক বিশেষজ্ঞরা; কিন্তু তাদের কোনো অনুমানই ঠিক হয়নি। রাশিয়া বারবার যুদ্ধের অধ্যায় পরিবর্তন করেছে। কখনো অগ্রসর হয়েছে দুর্দম গতিতে, কখনো পিছিয়েছে, কখনো বা নির্দিষ্ট এলাকা ও লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে, কখনো ব্যাপক হামলা চালিয়েছে, কখনো বা দখল করা ভূখ- ছেড়ে দিয়েছে। এই ধোঁয়াশায় পড়ে পশ্চিমা সামরিক বিশ্লেষকরা এখন বোঝার চেষ্টা করছেন, কোন কৌশলে এগোচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন?
গত ২১ সেপ্টেম্বর ভøাদিমির পুতিন যে বক্তব্য প্রদান করেছেন, তা থেকে স্পষ্ট হয়েছে- তিনি যুদ্ধের আশু লক্ষ্য থেকে সরে গেছেন। অপেক্ষা করছেন অনুকূল পরিস্থিতির জন্য। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম দ্য হিল এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, এখন পুতিনের লক্ষ্য ‘জমে যাওয়া’ নয় বরং ‘নিয়ন্ত্রিত’ যুদ্ধ।
যুদ্ধকে শীতকাল পর্যন্ত টেনে আনার মধ্যে পুতিনের যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যায়। আরও ধারণা পাওয়া যায় শীতকালের আগ মুহূর্তে হামলার বিস্তার ঘটানো থেকে। ইউক্রেন যে কাহিল হয়ে পড়ছে, তা-ও স্পষ্ট। তা হলে পুতিন কি ইউক্রেনকে ছাড়িয়ে অন্য কোনো বলয়কে সরাসরি সংঘাতে টেনে আনার কৌশল নিয়েছেন? সেটাই কি তার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য?
রাশিয়ার তরফে পারমাণবিক বোমা হামলার হুমকি তো রয়েছেই, পশ্চিমা সমরবিদদরা এখন পুতিনের যুদ্ধকৌশল নিয়েও চিন্তিত। রুশ ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যম থেকে যতদূর জানা গেছে, নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে রাশিয়ার ছদ্মবেশী মার্সিনারি/প্যারামিলিটারি সংগঠন ওয়াগনার গ্রুপ ও প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানিগুলো। ওয়াগনারের স্বত্বাধিকারী ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন সরাসরি রিপোর্ট করেন পুতিনের কাছে। এ ছাড়াও যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে রস্গ্ভার্দিয়া, এল/ডিএনআর মিলিৎসিয়া ইত্যাদি সংগঠন। এগুলো রিপোর্ট করে নিয়মিত বাহিনীর কাছে। নিয়মিত বাহিনীকে অনেকটা হাতে রেখে এসব প্রাইভেট বাহিনী ব্যবহার করাও যে পুতিনের যুদ্ধকৌশলের অংশ তা পরিষ্কার।
পুতিনের ২১ সেপ্টেম্বরের ভাষণের পর দনবাস নিজের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে রাশিয়া, যুদ্ধের অধিনায়ক বদল করেছে এবং আক্রমণ জোরদার করেছে। অন্যদিকে শাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন শীর্ষ সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে পুতিনের আলোচনার সময় যুদ্ধকৌশল পরিবর্তনের বিষয়টি ঘটে থাকতে পারে। তার ইঙ্গিত রয়েছে পুতিনের সেপ্টেম্বরের ওই ভাষণে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কুপ্রভাব শুরু হয়ে গেছে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে। বিশেষ করে ভোগান্তি শুরু হয়েছে পশ্চিম ইউরোপে। কিছু কিছু অশান্তি এরই মধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে, যা ওই দেশগুলোর সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর। যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে তাতে সন্দেহ নেই। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম দ্য এক্সপ্রেসের বিশ্লেষণ- রাশিয়া এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে চীনের অনুকূলে। খুবই সম্ভব যে পশ্চিমাদের দুর্বলতার মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছে চীন। এর পর সে হামলা করবে তাইওয়ানে।
এসব কারণেই কি যুদ্ধ থামাতে গড়িমসি করছেন পুতিন? এটাই কি তার ইউক্রেন যুদ্ধের কৌশল?

দৈনিক দেশ নিউজ ডটকম ডেস্ক 

























