ভারতের গুজরাত রাজ্যের আহমেদাবাদে কংগ্রেস সদর দপ্তরের সামনে একটা ইলেকট্রনিক বোর্ড লাগানো হয়েছিল। এখন নিশ্চই সেটা খুলে ফেলা হয়েছে। ওই বোর্ডে একটা স্বয়ংক্রিয় ঘড়ি ছিল- যেটা কাউন্টডাউন দেখাচ্ছিল যে বিজেপি আর ঠিক কত ঘণ্টা গুজরাতের ক্ষমতায় থাকবে। তবে কংগ্রেস নেতারাই কখনো বিশ্বাস করতেন না যে বিজেপিকে হারানো সম্ভব।বিবিসির রজনীশ কুমার একদিন কংগ্রেস দপ্তরে গিয়ে একটা আলোচনা শুনেছিলেন যেখানে এক নেতাকে বলতে শোনা গিয়েছিল যে ‘নরেন্দ্র মোদি তো গুজরাতের বাঘ।’ তাই গুজরাতে যে বিজেপিই ফের ক্ষমতায় আসবে, তা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ ছিল না।
মোদি কি ‘গুজরাতের বাঘ?’
বুথ ফেরত সমীক্ষাগুলো যেমন সেই ইঙ্গিত দিয়েছিল ভোটগণনার আগে, তেমনই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও জানত যে তারা জিততে পারবে না। কিন্তু যে রেকর্ডভাঙা জয় এসেছে বিজেপির, সেই ইঙ্গিত বিজেপির নেতারাও দিতে পারেননি। তাদের একটা আশঙ্কা ছিল যে হয়ত আসন কমে যাবে। আর তাই অনেক দিন আগে থেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন তারা।
‘নরেন্দ্র মোদির একটা নিজস্ব খবরাখবর নেওয়ার ব্যবস্থা আছে গুজরাতে। যখনই তিনি জেনেছিলেন যে করোনা-যুদ্ধে অব্যবস্থা চলছে, গোটা মন্ত্রীসভাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি,’ বলছিলেন আহমেদাবাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষক সতীশ মোরি। ‘গুজরাতিদের মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে যে নরেন্দ্র মোদি তাদের নেতা এবং তিনি কখনও কোনও ভুল কাজ করবেন না। তিনি যেটা বলেন, সেটাই করে দেখান।সেটা তো এই ভোটে কাজ করেইছে, তার সঙ্গে ছিল বিজেপির শক্তপোক্ত সংগঠনও। ক্যাডার ভিত্তিক দলের ক্ষেত্রে যা হয়, প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে এরা যোগাযোগ রাখে । এই নিবিড় যোগাযোগটাও ভোটারদের অন্য কোনও বিকল্প খুঁজতে দেয় না,’ বলেন তিনি।

কীভাবে কাজ করে বিজেপি?
বিজেপির ভোট ব্যবস্থাপণার মূলে থাকে নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা। একেকটি পাতায় মোটামুটিভাবে ৩০ জনের নাম থাকে আর ওই ৩০ জন ভোটারের দায়িত্ব দেওয়া হয় পাঁচ থেকে ছয় জন কর্মীকে।
এদের বলা হয় ‘পান্না প্রমুখ’। পান্না শব্দের অর্থ বইয়ের পাতা। ওই ‘পান্না প্রমুখ’রা নিয়মিত তার জন্য নির্দিষ্ট ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, খোঁজ নেন। সব ধরনের সুবিধা অসুবিধায় সহায়তা করতে এগিয়ে যান। এভাবে প্রতিটা বাড়ির অন্দরমহলে বিজেপি পৌঁছে গেছে। আগে এই ব্যবস্থাটা ছিল শহরকেন্দ্রিক। কিন্তু এখন গ্রামে গঞ্জে, এমন কি আদিবাসী অধ্যুষিত যে অঞ্চল চিরাচরিতভাবে কংগ্রেসের ভোট ব্যাঙ্ক ছিল, সেখানেও ‘গৈরিকীকরণ’ প্রায় সম্পূর্ণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ভাইবস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা দীপাল ত্রিবেদী ডেকান হেরাল্ড পত্রিকায় লিখেছেন, ‘১৯৬০ সালে গুজরাত রাজ্য গঠিত হওয়ার পরে এই প্রথমবার কংগ্রেস তার আদিবাসী ভোট ব্যাঙ্ক প্রায় সম্পূর্ণভাবে হারালো। ২৭টি আদিবাসী আসন আছে ১৮২ আসনের বিধানসভায়। ওই ২৭টির মধ্যে বিজেপি ২৪টিতেই জিতেছে।’
‘মোদি এখন ভগবান’
বেশিরভাগ গুজরাতি যখন ভোট দিতে যান, রাজ্য-শাসন বা উন্নয়ন তাদের কাছে মাপকাঠি নয়। তারা ভোট দেন হিন্দুত্বর ইস্যুতে, যেটার এখন নতুন নাম হয়েছে, ‘মোদিত্ব’, লিখেছেন মিজ ত্রিবেদী। ওই একই প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, ‘গুজরাতে হিন্দুত্বই কাজ করে, খুব হিংস্রভাবেই কাজ করে।’ উদাহরণ হিসেবে মিজ ত্রিবেদী বলছিলেন, ‘মোরবিতে, যেখানে ১৩৫ জন মানুষ সেতু ভেঙে পড়ে গিয়ে মারা গেলেন, সেখানে বিজেপির প্রার্থী জিতেছেন। আবার বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় যে কমিটি, তার অন্যতম সদস্য সি কে রাওলজী জয়ী হয়েছেন। তিনি তো ওই ধর্ষকদের বলেছিলেন তারা নাকি সংস্কারী ধর্ষক, কারণ তারা ব্রাহ্মণ।’
‘আবার দেখুন, নারোদা পাটিয়ার ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া এক ব্যক্তির চিকিৎসক কন্যাও বিজেপির টিকিটে জিতেছেন। ওই দোষী এখন নাকি অসুস্থতার কারণে জেল থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়েছে, তবে তিনি নিয়মিতই মেয়ের হয়ে প্রচার করেছেন।’
‘এসবই সম্ভব হয় কারণ এখানে মানুষ মি. মোদিকে ভগবান বলে মনে করেন,’ লিখেছেন দীপাল ত্রিবেদী। সতীশ মোরি বলেন, ‘করোনার অব্যবস্থার খবর জানতে পেরেই নরেন্দ্র মোদি গোটা মন্ত্রিসভা পাল্টিয়ে দিয়েছিলেন। ওই যে বলছিলাম তার একটা নিজস্ব নেটওয়ার্ক আছে, তা দিয়েই তিনি গুজরাত সরকারের কাজে নজর রাখেন।’
‘আবার মোরবির দুর্ঘটনার পরে সেখানকার বিধায়ককে এবার টিকিট দেওয়া হয়নি। যিনি জিতেছেন, তিনি আগেও বিধায়ক ছিলেন, আর সেতু ভেঙ্গে পড়ার সময়ে নিজে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করেছেন। এই বিষয়গুলোও মাথায় রাখা উচিত,’ মন্তব্য সতীশ মোরির।
গুজরাতে করোনার সময়ে যে অব্যবস্থা ছিল, যেভাবে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা চেপে দেওয়া হয়েছিল বা নিয়মিতই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া, দুর্নীতি, বেকারত্ব বা অবৈধ মদ ব্যবসার রমরমা চলে, অনেক সময়েই বিষাক্ত মদ পান করে মৃত্যুর ঘটনা সামনে আসে- এগুলো ওই রাজ্যে আর ভোটের ইস্যু হয় না।সেখানে যে ভারতের অন্য রাজ্যের তুলনায় দিনমজুরদের মজুরি প্রায় আশি টাকা কম, সেই প্রশ্নও কেউ তোলে না। এখন গুজরাতের ভোটারা ভোট দেন এই বিশ্বাসের ওপরে যে ‘আমি হিন্দু’। সেখানে অন্য কোনো মাপকাঠি আর কাজ করে না। খবর বিবিসি বাংলা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক /দৈনিক দেশ নিউজ ডটকম 

























