জাতিসংঘ ঘোষিত ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস পালিত হয়। আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস- ২০২১ উপলক্ষে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাককানইবি) সৃজনশীল প্ল্যাটফর্ম ‘উইম্যান পিস ক্যাফের’ শান্তি বিনির্মাণের কার্যক্রমগুলোর প্রতিফলন নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেন উইম্যান পিস ক্যাফে জাককানইবির প্রতিনিধিরা। তুলে ধরেছেন শান্তি প্রতিষ্ঠায় সংগঠনের কার্যক্রম ও কর্মসূচি।
‘হোয়াইট ডাভ’ প্রকল্পের গ্রুপ কোঅর্ডিনেটর জেসমিন খাতুন জানান, যদি আমরা প্রাচীনকালের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই সেখানে নারীরা ছিল নির্যাতিত, নিপীড়িত। কারণ তারা স্বাবলম্বী ছিল না, তারা অক্ষর জ্ঞানহীন ছিল। এখন যুগ আধুনিক হয়েছে তবুও কেন আজ অনেকাংশেই নারী নির্যাতিত? খবরের কাগজ খুললেই কেন নির্দয়ের মতো পুরুষ কর্তৃক নারীকে নির্যাতন করার দৃশ্য দেখতে পাই? আমি বলবো এর কারণ নারীর প্রতি অবহেলা, নারী প্রতি অন্যায়, নারীকে স্বাবলম্বী হতে না দেওয়া।
এরই ধারাবাহিকতায় তৃনমূল পর্যায়ের নারীদের সৃজনশীল কর্মকে কাজে লাগিয়ে নারীর ক্ষমতায়নে ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে উইমেন পিস ক্যাফের অন্যতম প্রজেক্ট হোয়াইট ডাভ। যেখানে এই প্রকল্পের মূলভাবনা হলো- একজন নারী নিজে স্বাবলম্বী হবে এবং অপরজনকে পথ দেখাবে।
জেসমিন খাতুন বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি নারীই স্বপ্ন দেখে আর তাদের শখের গন্ডির বাহিরে অনেক স্বপ্ন আর অব্যক্ত আশা সুপ্তাবস্থায় থেকে যায়। আর এই স্বপ্নকে বিকশিত করার নামই শান্তি। তন্দ্রাঘোরে আর কতকাল নিজের সৃজনশীলতাকে রুখে রাখা যায়, মানসিক প্রশান্তি এবং সুস্থ সুন্দর জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই পুরুষের পাশাপাশি সমান ভাবে এগিয়ে যেতে হবে নারীদের, শান্তি দিবস উপলক্ষে এ হোক আমাদের অঙ্গীকার।
আদিবাসী নারী ও তরুণদের মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাওয়া ‘শৈলসম’ প্রকল্পের সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবী প্রবীণ হেনরী ত্রিপুরা বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ৪৮টিরও অধিক বিভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। তারা প্রায় সময়ই বিভিন্নভাবে বৈষ্যমের শিকার হন। তাদের বসবাস প্রান্তিক অঞ্চলে হাওয়ায় সরকার বা বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থাদের সহায়তা তাদের কাছে পৌঁছায় না। এর মধ্যে বিশেষ করে আদিবাসী নারীরা আরও বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। ‘শৈলসম’ সে সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তাদের স্বাবলম্বীতা এবং একই সাথে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও মোকাবেলায় আদিবাসী যুবদের অংশগ্রহন নিশ্চিত করার মাধ্যমে আদিবাসী সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে।
বিগত বছরের মাঝামাঝি করোনাকালীন কঠিন পরিস্থিতিতে ‘শৈলসম’ দল প্রান্তিক আদিবাসী নারীদের কাছে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও করোনা ভাইরাস নিয়ে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়ার মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করে এবং একই সঙ্গে তাদের কাছে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিভিন্ন সামগ্রী পৌঁছে দেয়। সেসঙ্গে ২৫ জন আদিবাসী যুবদের মাঝে নেতৃত্ব, স্বাস্থ্য সচেতনতা, সহিংসতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘৃণামূলক বক্তব্য চিহ্নিত ও তা প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষন প্রদান করে। এছাড়াও আদিবাসী নারীরা যেন তাদের হাতের কাজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে পরিবারের জন্য বোঝা না হয়ে নিজেরা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হতে পারে সে লক্ষ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয় আর এভাবেই ‘শৈলসম’ আদিবাসী সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে।
উইম্যান পিস ক্যাফের কোষাধ্যক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া বিনতে সিদ্দিক জানান, নারীর প্রতি সহিংসতা সমাজকে পিছিয়ে দিচ্ছে। এ সহিংসতা কেবল ভুক্তভোগীর জন্যই নয়, সমাজের জন্যও ক্ষতিকর। যে শান্তি প্রচেষ্টায় নারীদের কোনো অবদান, ভূমিকা, মতামত, সম্মান ও তাদের অধিকার রক্ষার বিষয়টি সচেতন বা অসচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয় সেখানে আর যাই হোক মুক্তি এবং শান্তির দেখা মেলে না। তাই সমাজ ও জাতির শান্তি-সমৃদ্ধির জন্য একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মানে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করার কোনো বিকল্প নেই। আর এই কাজটিই বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে, সচেতনতা তৈরীর মাধ্যমে সহিংসতা রোধে কাজ করে যাচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উইম্যান পিস ক্যাফে। যেকোন নারী শিক্ষার্থীর সাথে কোনো ধরনের হয়রানির সংবাদ পেলে উইম্যান পিস ক্যাফে সর্বদা কঠোর ও সোচ্চার ভূমিকা রেখে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও তারা তাদের এসব অসাধারণ কাজ অব্যাহত রাখবেন সে আশা রাখি।
উইম্যান পিস ক্যাফের সহ-সভাপতি ফাইজাহ ওমর তূর্ণা ব্যক্তিগত জীবনে দক্ষতা উন্নয়নে উইম্যান পিস ক্যাফের ভূমিকা ও স্বাবলম্বী হওয়ার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বলেন, উইমেন পিস ক্যাফে শান্তি, সম্প্রীতি, সমতা, নারীর আত্মমর্যাদা ও আত্মনির্ভরশীল হওয়ার লক্ষ্যে ২০১৯ সাল থেকে কাজ করে চলেছে। সমাজে সমতা আনোয়ন এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে প্রত্যেক নারীর নিজের কর্মের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠা। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এখনও নারীরা পুরুষদের থেকে পিছিয়ে আছে, যা নারী ও পুরুষের মাঝে বৈষম্য সৃষ্টির কারণ। তাই সমতা আনয়নে নারীদের এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সাহসিকতা প্রদান করার জন্য উইমেন পিস ক্যাফে আইডিয়া ভিত্তিক উদ্যোক্তা ট্রেনিং এর আয়োজন করে যার লক্ষ্য ছিল সমাজিক সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে নারীকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা। তারই ধারাবাহিকতায় আমি নিজে ‘আঁরশিলতা’ নামক একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে নিজে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার চেষ্টা করি ও আমার কাজের মাধ্যমে অন্যদের উৎসাহিত করি।
উইমেন পিস ক্যাফে এই ধরনের উদ্যোগ তৈরিতে আমার ওপর পরোক্ষভাবে মনোবল তৈরি করতে সহায়তা করেছে। আমি মনে করি শান্তি আনয়নে নারী পুরুষের সমতা অপরিহার্য ও নারীর আত্মনির্ভরশীলতাই পারে নারীর ভেতরের ভীতিকে কাটিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে। উইমেন পিস ক্যাফে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও প্রজেক্টের মাধ্যমে নারী ও পুরুষদের আত্মোনির্ভরশীলতা আনয়নে সমান সহায়তা করে এসেছে শুরু থেকেই। শান্তি ও সমতা একে অপরের উপর নির্ভরশীল। শান্তি ও সমতা রক্ষায় উইমেন পিস ক্যাফের ভূমিকা সত্যিই প্রশংসনীয়।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় উইম্যান পিস ক্যাফের ভূমিকা নিয়ে সংগঠনটির সভাপতি মেশকাতুল জিনান বলেন, বাংলাদেশের নারীরা এখন সমাজে শান্তিপ্রতিষ্ঠায় ভুমিকা রাখছে খুব জোরালোভাবে, সমাজের এই শান্তি আরো বেগবান করতে এবং ধরে রাখতে প্রয়োজন নারী-পুরুষ সমতায়ন। যা ধীরে ধীরে বাংলাদেশে প্রসারিত হচ্ছে, এই প্রক্রিয়াকে আরো প্রসারিত করতে উইমেন পিস ক্যাফে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে যাচ্ছে তৃণমূল পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত। উইমেন পিস ক্যাফে বিশ্বাস করে সমাজে শান্তিপ্রতিষ্ঠার জন্য সমতা প্রয়োজন, সেই বিশ্বাস থেকে একটি সমতাপূর্ণ সমাজের লক্ষ্যে কাজ করে চলছে তারা।
উল্লেখ্য, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর উদ্ভাবনী ভাবনা বাস্তবায়ন এবং শান্তিপূর্ণ সমাজে নারী উদ্যোক্তা তৈরির জন্য একটি সৃজনশীল প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে উইম্যান পিস ক্যাফে, জাককানইবি। ইউএন উইম্যান এবং সেন্টার ফর পিস এন্ড জাস্টিস, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় সম্প্রতি করোনাকালীন সময়ে সংগঠনটির সরাসরি তত্বাবধানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও সারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের প্রায় ১০০ জন নারী শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে ৫ মাস মেয়াদি ৪টি প্রকল্প সম্পন্ন করে। প্রকল্প চারটি হলো- শৈলসম , ঐকতান, হোয়াইট ডাভ ও আমরা আনিব রাঙা প্রভাত। প্রতিটি প্রকল্পই নারীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, নারীর অধিকার, নারী পুরুষ সমতা, নারীকে আত্মবিশ্বাসী ও স্বাবলম্বী করে তুলতে সর্বোপরি সমাজে শান্তি বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক /দৈনিক দেশ নিউজ বিডি ডটকম 
























