শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বেনজীরের চেয়ে স্ত্রীর সম্পত্তি ২০ গুণ বেশি

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জিশান মির্জা ও তিন মেয়ের নামে ৬২৭ বিঘা জমির সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব স্থাবর সম্পদ জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া বেনজীর পরিবারের নামে থাকা গুলশানে ৯ হাজার ১৯৩ বর্গফুটের চারটি ফ্ল্যাট, ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ২৫টি কোম্পানিতে শতভাগ ও আংশিক বিনিয়োগ করা অর্থ অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর সিনিয়র বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আস্সামছ জগলুল হোসেন।

গত ৩১ মার্চ ‘বেনজীরের ঘরে আলাদিনের চেরাগ’ এবং ৩ এপ্রিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে একটি দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এতে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য উঠে আসে। এ বিষয়ে গত ১৮ এপ্রিল অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। তারই অংশ হিসেবে সম্পদ জব্দ করতে শুরু করেছে দুদক।

গত বৃহস্পতিবার ও রবিবার দুদিনে পুলিশের সাবেক সর্বোচ্চ এই কর্মকর্তার পরিবারের নামে ১৯৬টি দলিলে থাকা ৬২৭ বিঘা জমি জব্দ করা হয়। এসব সম্পদের মধ্যে বেনজীর আহমেদের নিজের নামে রয়েছে মাত্র ২৮ বিঘা, বাকি সম্পদ স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে। এর মধ্যে জিশান মির্জার নামেই রয়েছে ৫৪৩ বিঘা জমি। বেনজীরের নিজের জেলা গোপালগঞ্জের তিনটি উপজেলা ছাড়াও পাশর্^বর্তী মাদারীপুরের রাজৈরে এসব জমি কেনা হয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন ও উখিয়ার ইনানী এলাকায় বেনজীর আহমেদ নিজে, স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে জমি কিনেছেন।

আদালতের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেনজীর আহমেদ ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে এসব সম্পদ কিনেছেন। তিনি ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগমুহূর্তে ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে শুধু রাজৈরে জিশান মির্জার নামে প্রায় ২৮০ বিঘা জমি কেনেন। এ ছাড়া অবসর নেওয়ার ৬ মাসের মধ্যে ২০২৩ সালের ৫ মার্চ একই দিন গুলশানে ৪টি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এগুলোর মধ্যে স্ত্রীর নামে তিনটি ও তার নাবালিকা এক মেয়ের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।

অন্যদিকে জব্দ হওয়া অস্থাবর সম্পদের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখায় ৩০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্র, শাভান্তা ন্যাচারাল পার্ক লিমিটেড, শাভান্তা এগ্রো লিমিটেড, শাভান্তা ইকো রিসোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিসহ আটটি কোম্পানিতে শতভাগ শেয়ার রয়েছে। এ ছাড়া আরও ১৫টি কোম্পানিতে বেনজীর আহমেদের পরিবারের আংশিক শেয়ার থাকার তথ্য আদালতের নথি থেকে জানা যায়।

আদালত সূত্রে জানা যায়, সেন্টমার্টিনে পৌনে দুই একর জমি রয়েছে বেনজীরের নামে। ইনানীতে রয়েছে ৬২ শতাংশ জমি।

আদালতের আদেশের বিষয়ে ওই আদালতে দায়িত্বপ্রাপ্ত দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর জানান, সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ১৪ ধারা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা-২০০৭-এর বিধি ১৮-এর বিধানমতে বেনজীর আহমেদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে অপরাধসংশ্লিষ্ট স্থাবর সম্পদ ক্রোক এবং অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধকরণের আদেশ দিয়েছেন আদালত।

তিনি বলেন, অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে যেসব সম্পদ পাওয়া গেছে সেগুলো জব্দ করা হয়েছে। অনুসন্ধান যেহেতু চলমান, এই পরিবারের সম্পদের আরও তথ্য পাওয়া গেলে সেগুলোও জব্দ করতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, গোপালগঞ্জের সাহাপুর ইউনিয়নে সাভানা ইকো রিসোর্ট নামে প্রায় ১৪০০ বিঘা জমিতে একটি ইকো রিসোর্ট গড়ে তুলেছেন বেনজীর পরিবার। এ ছাড়া ঢাকা ও পূর্বাচলে এই সাবেক আইজিপির একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ি আছে। তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ছয়টি কোম্পানির খোঁজ পাওয়ার কথাও বলা হয় প্রতিবেদনে। পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যে হবিগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বেনজীর আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে দুদকে আবেদন জানান। এরপর ২৩ এপ্রিল দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন জানান, বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অর্জন অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছেন তারা। দুদকের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম এ অনুসন্ধান করছে। টিমের অপর দুই সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক নেয়ামুল আহসান গাজী এবং মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন।-দৈনিক আমাদের সময় |

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

সর্বাধিক পঠিত

বেনজীরের চেয়ে স্ত্রীর সম্পত্তি ২০ গুণ বেশি

প্রকাশিত সময় : ০৯:৫২:৪৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ মে ২০২৪

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী জিশান মির্জা ও তিন মেয়ের নামে ৬২৭ বিঘা জমির সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব স্থাবর সম্পদ জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া বেনজীর পরিবারের নামে থাকা গুলশানে ৯ হাজার ১৯৩ বর্গফুটের চারটি ফ্ল্যাট, ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং ২৫টি কোম্পানিতে শতভাগ ও আংশিক বিনিয়োগ করা অর্থ অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর সিনিয়র বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আস্সামছ জগলুল হোসেন।

গত ৩১ মার্চ ‘বেনজীরের ঘরে আলাদিনের চেরাগ’ এবং ৩ এপ্রিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে একটি দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এতে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য উঠে আসে। এ বিষয়ে গত ১৮ এপ্রিল অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। তারই অংশ হিসেবে সম্পদ জব্দ করতে শুরু করেছে দুদক।

গত বৃহস্পতিবার ও রবিবার দুদিনে পুলিশের সাবেক সর্বোচ্চ এই কর্মকর্তার পরিবারের নামে ১৯৬টি দলিলে থাকা ৬২৭ বিঘা জমি জব্দ করা হয়। এসব সম্পদের মধ্যে বেনজীর আহমেদের নিজের নামে রয়েছে মাত্র ২৮ বিঘা, বাকি সম্পদ স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে। এর মধ্যে জিশান মির্জার নামেই রয়েছে ৫৪৩ বিঘা জমি। বেনজীরের নিজের জেলা গোপালগঞ্জের তিনটি উপজেলা ছাড়াও পাশর্^বর্তী মাদারীপুরের রাজৈরে এসব জমি কেনা হয়েছে। এ ছাড়া কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন ও উখিয়ার ইনানী এলাকায় বেনজীর আহমেদ নিজে, স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে জমি কিনেছেন।

আদালতের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেনজীর আহমেদ ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে এসব সম্পদ কিনেছেন। তিনি ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগমুহূর্তে ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে শুধু রাজৈরে জিশান মির্জার নামে প্রায় ২৮০ বিঘা জমি কেনেন। এ ছাড়া অবসর নেওয়ার ৬ মাসের মধ্যে ২০২৩ সালের ৫ মার্চ একই দিন গুলশানে ৪টি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এগুলোর মধ্যে স্ত্রীর নামে তিনটি ও তার নাবালিকা এক মেয়ের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।

অন্যদিকে জব্দ হওয়া অস্থাবর সম্পদের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখায় ৩০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্র, শাভান্তা ন্যাচারাল পার্ক লিমিটেড, শাভান্তা এগ্রো লিমিটেড, শাভান্তা ইকো রিসোর্ট প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিসহ আটটি কোম্পানিতে শতভাগ শেয়ার রয়েছে। এ ছাড়া আরও ১৫টি কোম্পানিতে বেনজীর আহমেদের পরিবারের আংশিক শেয়ার থাকার তথ্য আদালতের নথি থেকে জানা যায়।

আদালত সূত্রে জানা যায়, সেন্টমার্টিনে পৌনে দুই একর জমি রয়েছে বেনজীরের নামে। ইনানীতে রয়েছে ৬২ শতাংশ জমি।

আদালতের আদেশের বিষয়ে ওই আদালতে দায়িত্বপ্রাপ্ত দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর জানান, সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ১৪ ধারা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা-২০০৭-এর বিধি ১৮-এর বিধানমতে বেনজীর আহমেদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নামে অপরাধসংশ্লিষ্ট স্থাবর সম্পদ ক্রোক এবং অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধকরণের আদেশ দিয়েছেন আদালত।

তিনি বলেন, অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে যেসব সম্পদ পাওয়া গেছে সেগুলো জব্দ করা হয়েছে। অনুসন্ধান যেহেতু চলমান, এই পরিবারের সম্পদের আরও তথ্য পাওয়া গেলে সেগুলোও জব্দ করতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, গোপালগঞ্জের সাহাপুর ইউনিয়নে সাভানা ইকো রিসোর্ট নামে প্রায় ১৪০০ বিঘা জমিতে একটি ইকো রিসোর্ট গড়ে তুলেছেন বেনজীর পরিবার। এ ছাড়া ঢাকা ও পূর্বাচলে এই সাবেক আইজিপির একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ি আছে। তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ছয়টি কোম্পানির খোঁজ পাওয়ার কথাও বলা হয় প্রতিবেদনে। পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যে হবিগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বেনজীর আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে দুদকে আবেদন জানান। এরপর ২৩ এপ্রিল দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন জানান, বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অর্জন অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছেন তারা। দুদকের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম এ অনুসন্ধান করছে। টিমের অপর দুই সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক নেয়ামুল আহসান গাজী এবং মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন।-দৈনিক আমাদের সময় |